আমাদের উচ্চশিক্ষা: মুজিববর্ষে অঙ্গীকার

শিক্ষাকেই উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করে বঙ্গবন্ধু ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘শিক্ষাই হবে মুক্তির হাতিয়ার।’ এই মুক্তি হবে সংকীর্ণতা থেকে মুক্তি, এই মুক্তি হবে মানবতার মুক্তি, এই মুক্তি হবে দরিদ্র, শোষিত জনগণের মুক্তি, দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি। তাই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন তিনি। পাশাপাশি মননশীল জাতি তৈরিতে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পকলার প্রতিও নজর দেন জাতির পিতা। এর আগে পাকিস্তান আমলেও যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়ার পর তিনি এ অঞ্চলের মানুষকে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করা ও এখানে শিল্পকারখানা স্থাপনের কথা বলেন।

পঞ্চাশের দশকে প্রাদেশিক শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালেই এ অঞ্চলের মানুষকে বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার ঐ উদ্যোগের ফলেই ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট। ১৯৫৬ সালে এক অনুষ্ঠানে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘দেশের প্রাপ্তব্য সম্পদের পরিপূর্ণ ব্যবহার এবং ইহাকে জনগণের কাজে লাগানই হইতেছে দেশকে শিল্পায়িতকরণের উদ্দেশ্য। কর্মসংস্থানের সুযোগ-সুবিধার সম্প্রসারণ ও ইহাকে সর্ব্বস্তরে বহুমুখীকরণই ইহার যুক্তিসঙ্গত ও অপরিহার্য্য পরিপূরক।’ (দৈনিক আজাদ, ৪ঠা অক্টোবর, ১৯৫৬)।

একটি জাতিকে গড়ে তুলতে যে শিক্ষার বিকল্প নেই তা অনুধাবন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭০-এর নির্বাচনের সময় টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে তিনি সুস্পষ্ট কিছু প্রস্তাব রেখেছিলেন, তা হচ্ছে, ‘প্রথমত, সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা খাতে পুঁজি বিনিয়োগের চেয়ে উত্কৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না। দ্বিতীয়ত, ‘নিরক্ষতা অবশ্যই দূর করতে হবে। পাঁচ বছর বয়স্ক শিশুদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্য একটি ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালু করতে হবে। তৃতীয়ত, দারিদ্র্য যেন উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মেধাবীদের জন্য বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।’

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বের একটি দেশে পরিণত করা। তিনি রাজশাহীতে এক জনসভায় বলেছিলেন,‘আমি কী চাই? আমার বাংলার বেকার কাজ পাক। গ্রামে গ্রামে সব শিল্পকে এমনভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে, যার ফলে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে বিভিন্ন প্রকার শিল্প সুযোগ পৌঁছায় এবং গ্রামীণ মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়।’ (৯ মে, ১৯৭২)

১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থেকে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক কাজ শুরু করেছিল। প্রতিটি জেলায় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপনের অংশ হিসেবে ১৮টি নতুন পলিটেকনিক স্থাপন, ২০টি পুরাতন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের আধুনিকীকরণ, দেশের ৬৪টি ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটকে টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে রূপান্তর, প্রায় আড়াই হাজার নতুন জনবল নিয়োগদান, পলিটেকনিক ও টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজে স্থায়ীভাবে দ্বিতীয় শিফট চালুকরণ ইত্যাদি উদ্যোগ।

আজ আমরা উন্নয়নের পথে অনেক দূর এসেছি, কিন্তু আরো অনেক দূর যাওয়া বাকি। দেশকে উন্নত করতে, এই সময়ে সবচেয়ে বেশি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন। বঙ্গবন্ধুর ছিল একটি স্বতন্ত্র শিক্ষাদর্শন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করতে হবে, যার দ্বারা চরিত্রবান, কর্মঠ এবং দক্ষ মানুষ সৃষ্টি করা যায়।’ (১৫ মার্চ ১৯৭৩)

স্বাধীনতার পর মাত্র কয়েক বছরেই তিনি ভঙ্গুর শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজিয়েছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষা সরকারিকরণ, সংবিধানে শিক্ষা বাধ্যতামূলক (১৭ নম্বর অনুচ্ছেদ), শিক্ষা কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনসহ নানা কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়।

২০২০ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে ২০২০-২১ সালকে ‘মুজিববর্ষ’ ঘোষণা করা হয়েছে। ‘মুজিববর্ষে’ আমাদের আকাঙ্ক্ষা, আমরা যেন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরো উন্নত করতে সক্ষম হই। আমাদের জনসংখ্যার যে বিপুল তরুণ রয়েছে, তারা যেন দক্ষ হয়ে ভবিষ্যতে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের হাল ধরতে পারে।

ইউনিসেফের তথ্যমতে, এখন বাংলাদেশে শিক্ষার হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২. ৯ শতাংশ। শিক্ষার হার বেড়েছে। স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের সংখ্যাও বেড়েছে। তবে এই সময়ে এসে আমাদের একটা প্রশ্ন থেকেই যায়—মানসম্পন্ন ও দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি করতে পেরেছি কি?

বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের আচার্য ও রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছেলেমেয়েদের মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে আছি। আমরা দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্পবিপ্লব সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারিনি। ঐ সময় বিশ্বের উন্নত দেশগুলো নেতৃত্ব দিয়েছে। তবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ আমাদের রয়েছে। আমাদের যে ৮ কোটির মতো তরুণ রয়েছে তাদের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষ করতে হবে। আর এটা সম্ভব।

উন্নত বাংলাদেশের এই ফ্রেমওয়ার্ক বাস্তবায়নে আমাদের তরুণদের শুধু সনদধারী বা ডিগ্রিধারী হলে চলবে না। একটা বিষয় প্রায়ই বলা হয়ে থাকে যে, দক্ষ লোকবল পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের ১৬ কোটির বেশি জনসংখ্যা, প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজগুলো থেকে হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট বের হন। এর মধ্যে অনেকেই ইংরেজি তো দূরে থাক বাংলায়ও সঠিকভাবে নিজের ভাব গুছিয়ে প্রকাশ করতে পারেন না।

চাকরিদাতারা বলেন, তারা দক্ষ লোকবল পান না। সনদধারী গ্র্যাজুয়েটরা বলছেন, চাকরি পান না। অন্যদিকে বাধ্য হয়ে চাকরিদাতারা বাইরে থেকে কর্মী নিয়োগ দেন। আমাদের প্রায় ১ কোটির বেশি শ্রমিক প্রবাসী। তারা বিদেশে নির্মাণশ্রমিকসহ বিভিন্ন কাজ করে থাকেন। এতে যা আয় করেন তা তাদের পরিশ্রমের তুলনায় বেশ কম। এসব অবস্থা থেকে আমাদের উত্তরণ প্রয়োজন। অথচ দক্ষ হয়ে বিদেশে গেলে যথেষ্ট সম্মান ও সম্মানী পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাই আমাদের বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজন। যদি সবাই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে, তবে সেখানে পেশাগত দক্ষতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীও কারিগরি ট্রেডে প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষ কর্মী হতে পারেন। উন্নত দেশে তা-ই হয়ে থাকে।

শিক্ষকদের উদ্দেশে জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘আগামী প্রজন্মের ভাগ্য শিক্ষকদের ওপর নির্ভর করছে। শিশুদের যথাযথ শিক্ষার ব্যত্যয় ঘটলে কষ্টার্জিত স্বাধীনতা অর্থহীন হবে।’ তাই প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে আমাদের শিক্ষকদের সমসাময়িক বিষয়াবলি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের গবেষণা বাড়াতে হবে, তা হবে অবশ্যই জনকল্যাণে।

ইউজিসির তথ্যমতে, বাংলাদেশে ৪৬টি পাবলিক এবং ৯৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। আরো বেশ কয়েকটি অনুমোদনপ্রাপ্ত সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রম চালুর অপেক্ষায় রয়েছে। এর মধ্যে নামকরা কিছু সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা অনেক শিক্ষার্থী অনেকটা আত্মবিশ্বাসী হয়ে কর্মক্ষেত্রে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করছেন।

শুধু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর অধিভুক্ত দুই সহস্রাধিক কলেজে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ! এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর পড়াশোনার পাশাপাশি দক্ষতা অর্জনের বিকল্প নেই।

বাংলাদেশে মোট কওমি মাদ্রাসা রয়েছে ১৩ হাজার ৯০২টি, যার মাঝে ১২ হাজার ৬৯৩টি ছাত্রদের জন্য এবং ১ হাজার ২০৯টি ছাত্রীদের। এখান থেকেও প্রতি বছর বের হওয়া শিক্ষার্থীরা কর্মক্ষেত্রে তেমন অগ্রাধিকার পায় না। তাদের অর্থনীতির মূলস্রোতে ফেরাতে মাদ্রাসাগুলোতে বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেওয়া এখন সময়ের চাহিদা।

আর কারিগরি শিক্ষার্থীরা বর্তমানে প্রয়োজনীয় কারিগরি প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকে, যা হয়তো স্বাভাবিক মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষেত্রে কাজের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জন সম্ভব হয়। এক্ষেত্রে চিন্তা করলে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষার্থীরা কর্মক্ষেত্রে অনেক উন্নতি লাভ করার কথা। কিন্তু বর্তমানে তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হচ্ছে না। কারণ হচ্ছে, তারা শুধু কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হতে শেখে, অন্যদিকে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এ অবস্থায় শিক্ষাব্যবস্থা যেমনই হোক না কেন, আমাদের প্রয়োজন বাস্তবধর্মী শিক্ষার। সেখানে থাকবে ডিগ্রি অর্জনের সঙ্গে পছন্দমতো পেশা নির্বাচন করার ক্ষমতা। চাকরিদাতারও এই অভিযোগ থাকবে না যে, তারা যোগ্য কর্মী পাচ্ছেন না। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রাক্কালে আমাদের প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পকারখানা তৈরিতে জোর দিতে হবে। এক্ষেত্রে নিজেরদের প্রয়োজনেই তরুণদের কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে।

১৯৭৩ সালের ১৮ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক জনসভায় জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘ছাত্র ভাইয়েরা, লেখাপড়া করেন। ডিগ্রি নিয়ে লাভ হবে না। ডিগ্রি নিয়ে মানুষ হওয়া যায় না। ডিগ্রি নিয়ে নিজের আত্মাকে ধোঁকা দেওয়া যায়। মানুষ হতে হলে লেখাপড়া করতে হবে।’

আমাদের তরুণরা মেধাবী। তারাই শক্তি। এ তরুণেরা গড়ে তুলবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। তারা অন্যদের অনুকরণ করব না, উদ্ভাবন করব। যা জনগণের কল্যাণে কাজে দেবে। রিসার্স ও নতুন নতুন উদ্ভাবনের মাধমে জনগণের সমস্যার সমাধান করবে, দেশের সমস্যা সমাধান করবে। সে লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ভূমিকা রাখতে হবে।’ বঙ্গবন্ধুর সেই সোনার বাংলা যার আধুনিক রূপ হচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের পরিকল্পনায় ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন বাস্তব। তরুণদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটা অন্তরের সম্পর্ক ছিল। তিনি তাদের সংগ্রামের বাণী দিতেন, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সক্রিয়তায় উত্সাহিত করতেন, শিক্ষা এবং শিক্ষার আদর্শগুলো নিজেদের জীবনে ধারণ করার জন্য অনুপ্রাণিত করতেন। তিনি চাইতেন বাঙালি তরুণ যুগের আদর্শগুলো ধরে রেখে বিশ্বমানব হোক। বঙ্গবন্ধুর কথায়, ‘দেশ যখন আমার আছে, মাটি যখন আমার আছে, বাংলার সোনার মানুষ যখন আছে ইনশাল্লাহ আমার যে স্বপ্ন সোনার বাংলা একদিন হবেই।’ মুজিববর্ষে আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে তার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলব—এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক: তথ্যপ্রযুক্তিবিদ; সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন


সর্বশেষ সংবাদ