১৫০ টাকার বই ১৮ হাজার টাকায় কিনেছে সরকারি কলেজ

  © ফাইল ফটো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) অধিভুক্ত সরকারি ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজের লাইব্রেরির জন্য ১৫০ টাকার বই ১৮ হাজার এবং ৩০০ টাকার বই ১৯ হাজার টাকায় কিনেছে কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটির লাইব্রেরির জন্য ক্রয়কৃত বই প্রকৃত দামের চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশি দিয়ে ক্রয় করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে কলেজটির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।

মেডিকেল কলেজে বইগুলো সরবরাহ করেছে মেসার্স হাসেম অ্যান্ড সন্স নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ৩৯২, নর্থ ইব্রাহিমপুর (মুন্সিবাড়ি) কাফরুলে প্রতিষ্ঠানটির অফিস। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ঢাকা মহানগর উত্তরের ১৬নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী।

২০১৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সরকারি ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ লাইব্রেরির বইয়ের জন্য ৭ লাখ ৯৯ হাজার ৯০০ টাকার কার্যাদেশ দেন প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. তৈয়েবুর রহমান। ১০ কার্য দিবসের মধ্যে এ বই সরবরাহের নির্দেশনা দেওয়া হয়। ওইদিন বইয়ের বাজার মূল্যের চেয়ে অস্বাভাবিক হারে বেশি মূল্য পরিশোধের জন্য একটি কার্যপত্র স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা বরাবর পাঠান ওই মেডিকেল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। সেই কার্যাদেশ পত্রের সব টাকাই তুলে নিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি।

রাজধানীর বিভিন্ন বইয়ের বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বই সরবরাহের অনুমোদিত তালিকায় থাকা লিপ্পিন কটস’র লেখা বায়োকেমিস্ট্রি ৫ম সংস্করণ বইটির মূল কপির দাম ১৫০ টাকা। তবে বইটি যদি ফটোকপি করা হয়, তাহলে দাম আরও কম হবে। অথচ মেসার্স হাসেম অ্যান্ড সন্স নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি এ বইটি সরবরাহ করেছে ১২ হাজার টাকায়। একইভাবে ভারতীয় লেখক হার্পার্সের লেখা ইলাস্ট্রেটেড বায়োকেমিস্ট্রি বইটি বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়। আর বইটি কেনা হয়েছে ১৮ হাজার টাকায়।

লেখক এটলাসের লেখা এ টেক্সট অব হিউম্যান অ্যানাটমি বইয়ের দাম ৭০০ টাকা। অথচ বইটি কেনা হয়েছে ১৮ হাজার টাকায়। লেখক গাইটন অ্যান্ড হলের লেখা মেডিকেল ফিজিওলজি বইটির মূল দাম ৩০০ টাকা। সেই বই কেনা হয়েছে ১৯ হাজার টাকায়। সাউথ এশিয়ান এডিশনের বায়োকেমিস্ট্রি বইয়ের মূল্য ৪০০ টাকা। অথচ বইটি কেনা হয়েছে ১৮ হাজার টাকায়। বি ডি চাউরাশিয়ার লেখা হিউম্যান এনাটমি ষষ্ঠ সংস্করণের বইয়ের মূল্য ৪০০ টাকা। বইটি কেনা হয়েছে ১৮ হাজার টাকায়। ডব্লিউ এফ গানংয়ের লেখা রিভিউ অব মেডিকেল ফিজিওলজি বইয়ের দাম ১৫০ টাকা। বইটির ক্রয় মূল্য দেখানো হয়েছে ১১ হাজার ৫০০ টাকা।

গোধসের লেখা মেডিকেল ফার্মাকোলজি ১২তম সংস্করণের বইটি মূল্য ২৫০ টাকা। অথচ বইটি কেনা হয়েছে ১৫ হাজার টাকা। লেখক পার্কের লেখা টেক্সটবুক অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোস্যাল মেডিসিন বইটি বিক্রি হচ্ছে মাত্র ২০০ টাকায়। অথচ কেনা হয়েছে ১২ হাজার টাকায়। আব্দুল গনির লেখা ভেষজ রসায়ন বইটি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকায়, অথচ কেনা হয়েছে ১ হাজার ২০০ টাকায়। ড. হাফিস উদ্দিনের লেখা অস্ত্রোপচারের কলাকৌশল বইটি বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়। বইটি সরবরাহ করা হয়েছে ২ হাজার টাকায়।

ভারতীয় লেখক প্রফেসর এসবি কটুরের লেখা এ টেক্সট বুক অব আয়ুর্বেদিক ফিজিওলজি বইয়ের মূল্য ৩০০ টাকা। সেই বইটি কেনা হয়েছে ৩ হাজার ২০০ টাকায়। বিবি আথা ভেলে নামের লেখকের বেসিক প্রিন্সিপাল অব আয়ুর্বেদা বইটির দাম ২৬০ টাকা, অথচ দুটি বই কেনা হয়েছে ৭ হাজার ৬০০ টাকায়। অষ্টাঙ্গ হৃদয়া অব ভাগবহাটা বইটির দাম ২৫০ টাকা। বইটি ক্রয় করা হয়েছে ১২ হাজার টাকায়। ডক্টর ম্যাঙ্গালোর গাউরি ভি রো লেখকের এল এ টেক্সটবুক অব স্বাস্থ্য বৃত্ত বইয়ের দাম মাত্র ২৬০ টাকা। অথচ সেই বই কেনা হয়েছে ৫ হাজার ২০০ টাকায়।

ডক্টর কে নিস্তেজওয়ার লেখকের আয়ুর্বেদিক ট্রিটমেন্ট ফর নার্ভিন ডিজঅর্ডার বইয়ের প্রতিটির মূল্য ৭৫ টাকায়। কিন্তু বইটি কেনা হয়েছে ৫ হাজার ২০০ টাকায়। একই লেখকের আয়ুর্বেদিক রেমেডিস ফর কম্মন স্কিন বইয়ের দাম মাত্র ৬০ টাকা, অথচ প্রতিটি বই কেনা হয়েছে ৫ হাজার ২০০ টাকায়। ডক্টর ভি ভি আথাভেলি নামের ভারতীয় লেখকের প্যাথোজেনেসিস ইন আয়ুর্বেদা বই কেনা হয়েছে ৫ হাজার ২০০ টাকায়। অথচ বইটি বিক্রি হচ্ছে মাত্র ২৫০ টাকায়।

ডক্টর সি ধারাকান্দা নামের লেখকের ইন্ট্রোডাকশন টু কায়াচিকিৎসা বইয়ের দাম ৩০০ টাকা, যার প্রতিটি কেনা হয়েছে ৬ হাজার টাকা করে। ডক্টর এম এল কে মেথা অ্যান্ড ডক্টর রাহু নামদান যৌথ লিখিত আয়ুর্বেদিক ফার্মেসি বইয়ের দাম ৪০০ টাকা, অথচ প্রতিটি বই কেনা হয়েছে ৫ হাজার ৭০০ টাকায়। বিবি আথা ভেলে লেখক ইন কার্ডিওলজি ইন আয়ুর্বেদা বইয়ের মূল্য ২০০ টাকা। অথচ প্রতিটি বই ৩ হাজার ৮০০ টাকা করে দুটি বিক্রয় করা হয়েছে ৭ হাজার ৬০০ টাকায়। ডক্টর ডিঙ্গারি শালাকিয়া তন্ত্র নামের বইটির মূল্য ৫৭৫ টাকা, অথচ প্রতিটি বই ৩ হাজার ২০০ টাকা করে মোট দুটি বই কেনা হয়েছে ৬ হাজার ৪০০ টাকায়।

মেসার্স হাসেম অ্যান্ড সন্সের স্বত্বাধিকারী আজগর আলীর কাছে বইয়ের দামের এত বড় অসঙ্গতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বইগুলো দিল্লি থেকে আনতে হয়েছে। তাই দাম একটু বেশি পড়েছে। তাছাড়া ঢাকার নীলক্ষেত্রে প্রতিটি বই পাওয়া যাচ্ছে ১৫০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে। অথচ আপনি এসব বইয়ের দাম ধরেছেন ১২ থেকে ১৯ হাজার টাকা পর্যন্ত। এমন প্রসঙ্গে তিনি কথা বলতে বিব্রতবোধ করেন। কোনো কথা না বলে কিছুক্ষণ চুপ থাকেন।

এ সময় আজগর আলী বলেন, ফোনে তো এসব আলাপ করে লাভ নেই। আপনি আসেন সামনা-সামনি কথা বলি। আমি একটু মিটিংয়ে আছি। আপনি কখন আসবেন জানালে একসঙ্গে বসে চা খাব। আর কথা বলব। এরপর তিনি মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্বে থাকা ডা. মো. তৈয়ুবুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, এ বিষয়ে কাগজপত্র না দেখে আমি কিছু বলতে পারছি না। এসব ইন্ডিয়ান বইতো, বাংলাদেশে পাওয়া যায় না। এজন্য দাম একটু বেশি পড়েছে। কিন্তু প্রায় সবগুলো বই বাংলাদেশের বইয়ের বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।

আপনি যে বই ১৮ হাজার টাকায় ক্রয় করেছেন, সেটা মিলছে ১৫০ টাকায়। তাহলে এটা কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে তার অফিসে গিয়ে কথা বলতে বলে মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। [সূত্র: খোলা কাগজ]


সর্বশেষ সংবাদ