সংস্কারে অনীহা: ধ্বংসের পথে স্বোপার্জিত স্বাধীনতা

ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর দুই লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে এদেশের স্বাধীনতা। পৃথিবীর মানচিত্রে মাথা উঁচু করে স্থান করে নিয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ’৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬ এর ছয় দফা, ’৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে এদেশের স্বাধীনতা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে নির্মাণ করা হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ইতিহাস বহনকারী ভাস্কর্য। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মহান মুক্তিযুদ্ধ স্মরণে দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মিত হয়েছে নানা ভাস্কর্য। এগুলোর মধ্যে জয়দেবপুর চৌরাস্তায় ১৯৭৩ সালে ভাস্কর আবদুর রাজ্জাকের নির্মিত জাগ্রত চৌরঙ্গী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৯ সালে ভাস্কর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালেদ নির্মিত অপরাজেয় বাংলা, ১৯৮৮ সালে ভাস্কর শামীম সিকদার নির্মিত স্বোপার্জিত স্বাধীনতা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯০ সালে ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান নির্মিত সংশপ্তক, ১৯৯১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাস্কর নিতুন কুন্ডু নির্মিত সাবাস বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য।

নির্মিত প্রতিটি ভাস্কর্যের পেছনে রয়েছে একেকটি সংগ্রামের গল্প। ভাস্কর্যগুলো নিছক জড়বস্তু নয়, বরং ইতিহাস ঐতিহ্যের অংশ। এগুলো মাথা উঁচু করে বলছে অধিকারের কথা, ত্যাগের কথা। এই ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে অন্যতম স্বোপার্জিত স্বাধীনতা। স্বোপার্জিত স্বাধীনতা ভাস্কর্যটি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের একটি খণ্ডচিত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সড়কদ্বীপে স্থাপিত এ ভাস্কর্যটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর। ভাস্কর শামীম সিকদার এ ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন।

১৯৮৮ সালের ২৫ মার্চ ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করা হয়। মূলভূমি থেকে ১৩ ফুট উচ্চতায় ১২ ফুট ৪ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য ও ৮ ফুট ৪ ইঞ্চি প্রস্থের ভাস্কর্যটি দাঁড়িয়ে রয়েছে। সিমেন্ট, বালু, রড ও পাথর স্বোপার্জিত স্বাধীনতা ভাস্কর্যের উপকরণ।

চতুষ্কোণ বেদির ওপর নির্মিত এই ভাস্কর্যের পুরো গা জুড়ে রয়েছে একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদারদের অত্যাচারের একটি খণ্ড চিত্র। উপরে বামে আছে মুক্তিযোদ্ধা কৃষক আর ডানে অস্ত্র হাতে দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা। মাঝখানে অস্ত্র হাতে নারী ও পুরুষ যোদ্ধারা উড়িয়েছে বিজয় নিশান। কিন্তু পতাকা ওড়ানোর জন্য বাঙালি যে রক্ত দিয়েছে, সয়েছে নির্যাতন, তার কটি খণ্ড চিত্র বেদির চারপাশে চিত্রায়িত। এ ভাস্কর্য বেদির বাম পাশে আছে ছাত্র-জনতার ওপর অত্যাচারের নির্মম চেহারা।

মূলত, বাংলাদেশের সব ধরনের জাতীয় আন্দোলনে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সবসময়ই জড়িয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অসামান্য অর্জন ও অবদানের কথা মাথায় রেখে ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়। তবে, সাম্প্রতিক সময়ে পরিচর্যার অভাবে ধ্বংস হতে বসেছে স্বাধীন দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বহনকারী ভাস্কর্য স্বোপার্জিত স্বাধীনতা।

সরেজমিনে দেখা যায়, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই ঐতিহ্য হারানোর উপক্রম দেখা যাচ্ছে। জড়াজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে ভাস্কর্যটি। ডান দিকের বাঙ্গালী বীর যোদ্ধার হাতে থাকা অস্ত্রের পলেস্তারা খসে পড়েছে এবং ভেতরের রড বের হয়ে গেছে। গত দু’বছরের বেশি সময় ধরে ভাস্কর্যের অস্ত্রটি ভাঙ্গা অবস্থায় রয়েছে। অথচ তা সাড়াবার কোনো উদ্যোগ নেই। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অসামান্য অবদানের কারণে এ ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে অথচ সে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ তার দায় নিতে অহীহা প্রকাশ করছে ।

সঠিক পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকমত না করার কারনে স্বোপার্জিত স্বাধীনতার পাদদেশে কোণো অনুষ্ঠান হলে প্যান্ডেল করার জন্য ভাস্কর্যের সাথে রশি দিয়ে বেধে প্যান্ডেল করা হয়। যার কারণে আরো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভাস্কর্যটি। অনেক সময় দেখা যায় ভাষ্কর্যের উপরে উঠে কেউ বসে অথবা শুয়ে আছে।

বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষকে জানানো হলেও তারা ভাস্কর্য রক্ষাণাবেক্ষণে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তারা জানিয়েছেন, এর আগেও সোপার্জিত স্বাধীনতা ভাঙ্গার বিষয়টি তারা প্রশাসনকে অবহিত করলেও তারা কোন ব্যবস্থা নেয়নি।

প্রশাসনের এমন উদাসীনতায় হতাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা জানিয়েছেন, নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে । এ দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস রক্ষার্থে এ ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ তার ঠিকমত রক্ষণাবেক্ষণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন করছে না। এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য খুবই লজ্জাজনক বলে তারা জানিয়েছেন।

ঢাবির মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী নায়িম আহমেদ বলেন, ‘এই ভাস্কর্য আমাদের দেশের বিভিন্ন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক-বাহক। কিন্তু আমাদের উদাসীনতার কারণে এগুলো দিনে দিনে ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। তাই আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এগুলোকে অতিসত্বর রক্ষণাবেক্ষণ করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।’

মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চের কেন্দ্রীয় সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল বলেন, ‘বাংলাদেশে যেখানে মুক্তিযোদ্ধারাই অবহেলিত, সেখানে একটি ভাষ্কর্যের ক্ষতিসাধন কোনো আহামরি বিষয় না। এটা কর্তৃপক্ষের চূড়ান্ত দায়ীত্বহীনতার প্রতিফলন। যার যার কাজ সঠিকভাবে করলে আজ সমাজের এই করুণ পরিণতি হত না।’

বিষয়টি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. গোলাম রব্বানী বলেন , ‘যখনি বিষয়টি আমাদের নজরে আসবে আমরা ব্যবস্থা নিব ।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘দুই বছর ধরে ভাঙ্গা, অথচ আমি জানিনা। আমি মাত্র শুনলাম। যারা এ ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেছিল তাদের বলতে হবে। ভাস্কর্যটি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হবে তা ভাঙ্গা থাকবে না ।’


সর্বশেষ সংবাদ