মেয়াদ উত্তীর্ণ সাইকেলে চলছে ‘ডিইউ চক্কর’

‘জোবাইকে’ আশার চেয়ে হতাশাই বেশি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভব‌নের পা‌শের ক্যাম্পাস শ্যা‌ডোতে রাখা ব্যবহার অনুপযোগী বাইসাইকেল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভব‌নের পা‌শের ক্যাম্পাস শ্যা‌ডোতে রাখা ব্যবহার অনুপযোগী বাইসাইকেল  © টিডিসি ফটো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচনী ছাত্রলীগের ইশতেহারে অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে চালু করবে অ্যাপ ভিত্তিক সাইকেল সেবা ‘জোবাইক’। প্রাথমিকভাবে তারা এর নাম দেন ‘ডিইউ চক্কর’। ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগ জয়ী হলেও জোবাইক ঢাবি ক্যাম্পাসে আনা নিয়ে শুরু হয় নানা তালবাহানা।

নানা নাটকীয়তার পরে গত ৩০ সেপ্টেম্বর প্রাথমিক পরীক্ষার জন্য ২০-২৫টি বাইসাইকেল জোবাইকসেবার উদ্দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আনা হয়। এর কয়েকদিন পর থেকেই ‘জোবাইক’ সেবা চালু হলেও ১৬ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা করে জোবাইক ‘ডিইউ চক্কর’। ডাকসুর উদ্যোগে পরিবহন সম্পাদক শামস ই নোমানের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড মো আখতারুজ্জামান একশোটি বাইসাইকেল দিয়ে এই সেবার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।

সকাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ.এফ রহমান
হলের সামনে পড়ে আছে অকার্যকর দুই বাইসাইকেল 

জোবাইক- স্মার্টফোনভিত্তিক বাইসাইকেলসেবা। এই সেবা পেতে গুগল প্লে স্টোর থেকে স্মার্টফোনে একটি অ্যাপ ডাউনলোড করতে হয়। পরে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে তৈরি করতে হয় একটি অ্যাকাউন্ট। এরপর ব্যবহারকারী বাইসাইকেলের গায়ে থাকা কিউআর কোড (QR Code) স্ক্যান করে বাইসাইকেল আনলক করে চালাতে পারবেন। এর জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণে এবং নামমাত্র অর্থ পরিশোধ করতে হয় সেবাগ্রহীতাকে।

ইতোমধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি ক্যাম্পাসে জোবাইক চালু হলেও এর মান নিয়ে অসন্তোষ ছিলো শুরু থেকেই। পরে সে উদ্যোগ গোড়াতেই নষ্ট হয়। তাই এমন সেবা এ ক্যাম্পাসে চালু করা নিয়ে প্রথম থেকেই পক্ষে-বিপক্ষে নানান বিতর্ক চলে। 

অন্যান্য ক্যাম্পাসে এর নিন্মমান সেবার সূত্র ধরে ঢাবিতে চালুকৃত জোবাইক নিয়ে শুরু থেকে ছিল নানা অভিযোগ। এসব সমালোচনা উপেক্ষা করে ঢাবিতে জোবাইক চালু হলেও বর্তমান সময়ে জোবাইক শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে উপকারের পাশাপাশি এর মান এবং অপ্রতুলতা এবং যান্ত্রিক ত্রুটি ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে শিক্ষার্থীদের জন্য।

ঢাবির জোবাইক আরোহী শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ঢাবিতে চলমান জোবাইক নানা সমস্যায় জর্জরিত। তাদের অভিযোগ, ঢাবিতে চলমান জোবাইকগুলোর বেশির ভাগ সাইকেলই পুরাতন। রঙের চাকচিক্যে শিক্ষার্থীদের কাছে তা শোভনীয় করে রাখলেও এর ব্যবহারে নানান সমস্যায় পড়ছেন আরোহীরা। অনেক সময় রাস্তায় সাইকেলের চেইন ছিড়ে যায়। অনেক সাইকেলের বেল ঠিক মত বাজে না আবার সাইকেলে বসার সিট উঠানামা করানোর সিস্টেমটা অনেক সময় কাজ করে না। যার কারণে আরোহীদের বসতে সমস্যা হয়। তাছাড়া সাইকেল খোলার জন্য জোবাইক ক্যাম্পানি সাইকেলের গায়ে যে কিউআর কোড দিয়েছেন সে কোড অ্যাপ দিয়ে স্ক্যাণ করলে অনেক সময় কাজ করেনা। আবার কাজ করলেও চালানোর সময় দেখা যায় সাইকেল নষ্ট। যার ফলে বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীদের গুণতে হয় স্টার্টিং চার্জ (অন করলেই দুই টাকা কেটে নেয়)।

শিক্ষার্থীরা জানান, অনেক সময় নষ্ট সাইকেল, চার্জহীন সাইকেল পড়ে থাকে বিভিন্ন স্পটে, তবে সেগুলোর যথাযথ তদারকি এবং সংস্কার সময়তো করা হয় না। ফলে সেগুলো কোনো উপকারে আসে না শিক্ষার্থীদের।

অনেক সময় কিউআর কোড কাজ না করলে সাইকেলের গায়ে আনলক করার জন্য অতিরিক্ত একটি নাম্বার দেওয়া হয়েছে কিউআর কোডের বিপরীতে ব্যাবহারের জন্য। তবে জোবাইকের গায়ে দেওয়া কোডের একটি সংখ্যা ভুল করলে জোবাইক কম্পানির ঐ নাম্বারের অন্য জায়গার বা ক্যাম্পাসের অন্য সাইকেল খুলে যায়। লক খুলে যাওয়ার সাথে সাথে শুরু হয় মিনিট গণনা যার ফলে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে লোকসান গুণতে হয় ব্যবহারকারীদের। পরে জোবাইক কোম্পানিকে ফোন দিয়ে অনাকাঙ্কিত আনলক হয়ে যাওয়া জোবাইকটি বন্ধ করতে হয়।

কখনো আবার সাইকেল চালানো শেষ হলে সাইকেল লক করতে চাইলে সাইকেল লক হলেও অ্যাপে মিনিট কাউন্ট হয় যার কারণে গুনতে হয় অতিরিক্ত টাকা। সাইকেল পুরাতন হওয়ায় সাইকেল চালানোর সময় সাইকেল রাস্তায় শব্দ করে । এসব কারণে জোবাইক নিয়ে শিক্ষার্থীদের যে আশা ছিল তার চেয়ে হতাশা বেশি।

ঢাবির পালি ও বুদ্ধিস্ট বিভাগের শিক্ষার্থী নজিব। তিনি স্যার এ এফ রহমান হল থেকে জোবাইকে করে জগন্নাথ হলে গিয়েছিলেন খেতে। তিনি জগন্নাথ হলে পৌঁছানোর পরে নিজহাতে সাইকেল লক করেন। তবে সাইকেল লক হলেও অ্যাপ সচল ছিল। কিন্তু তিনি তা জানতেন না। এসময় তার জোবাইকের ব্যালেন্স ছিল ৫৬ টাকা। পরে সকালে তিনি দেখতে পান তার ৫৬ টাকা কেটে মাইনাস হয়েছে ২৯৪ টাকা। তিনি সর্বোচ্চ ১০ মিনিট সাইকেল চালালেও অ্যাপ এ দেখাচ্ছে ৯০০ মিনিট।
এ ব্যাপারে নজিব বলেন, ‘আমি গিয়েছিলাম জগন্নাথ হলে খেতে। আমি সেখানে গিয়ে সাইকেল লক করি। কিন্তু সাইকলে লক হলেও অ্যাপ সচল ছিল। আমি রাতে দেখিনি। সকাল বেলা দেখি ৯০০ মিনিট । এজন্য আমার অনেক টাকা ক্ষতি হয়েছে পরে আমি জোবাইক কোম্পানিকে বিষয়টি জানালে তারা কোন ব্যবস্থা নেননি।’

ইসমাইল নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ঢাবি ক্যাম্পাসে জোবাইক আসবে এটা আমাদের প্রত্যাশা ছিল। জোবাইক যখন আসে তখন আমরা খুব খুশি ছিলাম। তবে জোবাইকের নানা সমস্যা আমাদের হতাশ করেছে। তাছাড়া, সাইকেলের সংখ্যাও অনেক কম। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ডাকসুর কাছে দাবি থাকবে তারা যেন এগুলো ওভারকাম করে আমাদের যে প্রত্যাশা তারা যেন তা পূরণ করে।’

সমস্যার বিষয়ে জানতে চাইলে জোবাইক কনসালট্যান্ট বিশাল বসু বলেন, ‘অ্যাপসে টেকনিক্যাল সমস্যা থাকতে পারে। তবে আমাদের সাইকেল নিম্নমানের না। এখানে আমাদের নতুন আরো সাইকেল আসছে। ঢাবির চাপের কারণে আমরা নতুন করে এখানে সাইকেল সেবা চালু করেছি। যার কারণে সমস্যাগুলো হচ্ছে। আমরা এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে এই সমস্যার সমাধান করে ফেলবো।’

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) পরিবহন সম্পাদক শামস ঈ নোমান বলেন, ‘সাইকেলে কিছু সমস্যাতো থাকবেই। শুরুতে সবগুলো তো পরিবর্তন করা সম্ভব না। সাইকেল পুরাতন থাকবেই। নতুন কিছু সাইকেল নভেম্বরে আসছে।’


সর্বশেষ সংবাদ