অনিয়মের মাধ্যমে এমফিলে ভর্তি হন রাব্বানী

ছাত্রলীগের সদ্যবিদায়ী সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) জিএস (সাধারণ সম্পাদক) গোলাম রাব্বানীর এমফিল ভর্তিতে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ডাকসু নির্বাচনের আগে ছাত্রলীগের ৩৪ নেতার বিরুদ্ধে ভর্তি জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক ও প্রশাসনিক ভবনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান তার বিশেষ ক্ষমতা বলে নিয়মের তোয়াক্কা না করে রাব্বানীর ভর্তিতে সহযোগিতা করেছেন। তবে ভিসি ও রাব্বানী দুজনই এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তারা বলছেন, সবকিছুই নিয়ম মাফিক হয়েছে। এদিকে এ খবরে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন উপ-উপাচার্য।

ডাকসু নির্বাচন হয় গত ১১ মার্চ। সেই নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পূর্বশর্ত হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়া। সেখানে এমফিল শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ছাত্র হিসেবে গণ্য হবেন বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। রাব্বানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই আইন বিভাগে পড়াশোনা করেছেন একসময়। ২০০৭-০৮ সেশনে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হয়ে ২০১১ সালে স্নাতক সম্পন্ন করেন তিনি। এর আট বছর পর চলতি বছরের শুরুতে ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের এমফিলের শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হন তিনি। এ ক্ষেত্রে তিনি ভিসি ও অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমানের আনুকূল্য পেয়েছিলেন।

রেজিস্ট্রার ভবন থেকে জানা যায়, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ২০১৮-১৯ সেশনে এমফিল ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আবেদন আহ্বান করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্র্তৃপক্ষ। ১০ অক্টোবর ছিল দরখাস্ত জমা দেওয়ার শেষ দিন। জমা পড়া আবেদনগুলো থেকে চূড়ান্তভাবে কয়েকটি বেছে নেওয়ার জন্য জানুয়ারিতে বিভিন্ন অনুষদের সভা হয়। অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অন্তর্ভুক্ত একটি বিভাগ। এ অনুষদের সভাটি হয় ১৬ জানুয়ারি। তবে ওই সভায় অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের পক্ষ থেকে কোনো এমফিল প্রস্তাবনা উপস্থাপিত হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী, বোর্ড অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজের সভা হয় ২২ জানুয়ারি। আর ২৪ জানুয়ারি অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সভা বসে।

এরই মধ্যে ১১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্র্তৃপক্ষ ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। তফসিলে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয় ১১ মার্চ।

নির্বাচনে প্রার্থিতা নিশ্চিত করতে ভিসি ও অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান রাব্বানীর থিসিস প্রস্তাবনাটির অনুমোদন দেন। ফলে রাব্বানী ডাকসু নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য কাঙ্খিত ছাত্রত্বের অধিকারী হন।

শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিটি থিসিস প্রস্তাবনা পাঁচটি ধাপে অনুমোদিত হওয়ার পরই প্রার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল গবেষক হিসেবে ভর্তির সুযোগ পান। এই প্রক্রিয়ার শুরু নির্দিষ্ট বিভাগের সব শিক্ষকের সমন্বয়ে গঠিত অ্যাকাডেমিক কমিটির বৈঠকের মাধ্যমে। এরপর তা সংশ্লিষ্ট অনুষদের ডিনের সভাপতিত্বে সব বিভাগের চেয়ারম্যান ও অধ্যাপকদের সমন্বয়ে অনুষদ সভায় উত্থাপিত হয়। সেখানে পাস হলে প্রস্তাবনাটি বোর্ড অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজে পাঠানো হয়। এই বোর্ডে ভিসির সঙ্গে বিভিন্ন বিভাগের অধ্যাপকরা থাকেন। এরপর তা পাঠানো হয় অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে। ভিসির পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য, সব বিভাগের চেয়ারম্যান, ডিন, পরিচালক ও অধ্যাপকরা এই কাউন্সিলের সদস্য। কাউন্সিলে প্রস্তাবনাটি পাস হলে তা পাঠানো হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে। এই পাঁচটি ধাপের মধ্যে থিসিস প্রস্তাবনাটির খুঁটিনাটি যাচাইয়ে মুখ্য ভূমিকা রাখে অনুষদ সভা। রাব্বানীকে ভর্তি করানোর ক্ষেত্রে অনুষদ সভা ও বোর্ড অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজের বৈঠকে এ দুটি ধাপ এড়িয়ে যান অপরাধবিজ্ঞানের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া।

রাব্বানীর ভর্তির ক্ষেত্রে যাবতীয় অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ভিসি মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘ভর্তি প্রক্রিয়ায় কোনো রকম অনিয়ম হয়নি। সবকিছুই নিয়মের মধ্যে করা হয়েছে।’ অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের মাধ্যমে সব হয়েছে। এখন অভিযোগ ওঠায় কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে কি না, এ প্রশ্নের জবাব দেননি ভিসি।

অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে ফোনে কোনো কথা বলবেন না বলে জানান। দুদিন পর অফিসে এসে দেখা করে কথা বলতে বলেন।

ওদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সূত্রগুলো বলছে, বোর্ড অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজের বৈঠকের সময় এবং আলোচ্য বিষয়সূচি বৈঠকের আগের দিনই চূড়ান্ত হয়।

জানুয়ারি মাসে বোর্ড অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজের যে বৈঠক হয়েছে সেখানে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ থেকে কোনো এমফিল প্রস্তাবনা ছিল না। ওই বৈঠকের দুদিন পর বিকেল ৩টায় অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের বৈঠক শুরু হলে উপাচার্য একজন ডেপুটি রেজিস্ট্রারকে ডেকে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাঠানো তথ্য বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে যোগ করে নিতে বলেন।

সংশ্লিষ্ট ওই সূত্র বলছে, এরপর ওই কর্মকর্তা অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাঠানো পাতাটি প্রিন্ট করে নেন। সেখানে এমফিল ভর্তিচ্ছু হিসেবে গোলাম রাব্বানী এবং আরও তিনজনের নাম ছিল। এরপর ভিসি বৈঠকে প্রস্তাবনাটি পাস করে দেন।

এ বিষয়ে ঢাবির ডেপুটি রেজিস্ট্রার জামাল আহমেদ বলেন, ‘অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সভা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পর অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ থেকে এই ডকুমেন্টস আসে। আমাদের বলা হয়, এটার এক কপি প্রিন্ট দিয়ে তা সভার আলোচ্যসূচির সঙ্গে যুক্ত করে দিতে। যেভাবে বলা হয়েছিল, আমরা সেভাবেই করেছি।’

এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, ‘গোলাম রাব্বানীর কোনো থিসিস প্রস্তাবনা অনুষদের সভায় আসেনি। ওই বিভাগের (অপরাধবিজ্ঞান) চেয়ারম্যানও এই অনুষদ সভার সদস্য। কিন্তু তিনি সেটা এখানে ওঠাননি।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনুষদ সভায় উত্থাপিত না হলে কোনো থিসিস প্রস্তাবনাই অনুমোদন পাওয়ার কথা নয়। এটা হয়তো টেবিল এজেন্ডার মাধ্যমে হয়েছে।’ এই ভর্তি প্রক্রিয়া কীভাবে সম্পন্ন হলো জানতে চাইলে অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, ‘এটা ওই বিভাগের চেয়ারম্যান ভালোভাবে বলতে পারবেন।’ এ বিষয়ে অনুষদের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, এ প্রশ্নের জবাবে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন বলেন, ‘এটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্র্তৃপক্ষের ব্যাপার।’

এ বিষয়ে ঢাবির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সামাদ (প্রশাসন) বলেন, ‘আমি এটা বিশ্বাসই করতে পারছি না এমন হয়েছে। এ ঘটনার তদন্ত হওয়া উচিত। যেহেতু এখতিয়ার আছে, উপাচার্যের এ বিষয়ে তদন্ত করা উচিত।’ এ ব্যাপারে উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমেদ বলেন, ‘এই অভিযোগ সত্য হলে কীভাবে ভর্তি হলো এটা তো আশ্চর্যের বিষয়। কয়েকজনের জন্য তো আমরা ভর্তি প্রক্রিয়া নষ্ট করতে পারি না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘সবকিছু নিয়মমতো হয়েছে। আমি সেপ্টেম্বরে আবেদন জমা দিয়েছি। প্রসিডিউরগুলো বিভাগ দেখে। সেখানে কোনো সমস্যা হলে সেটা তো আমার বিষয় না।’


সর্বশেষ সংবাদ