সেই ট্র্যাজেডিতে তিন দিন শোক পালন করেছিল জাতি

প্রথম বর্ষে মার্কেটিং বিভাগে প্রথম হয়েছিলেন তুষার দাস। আট সন্তানের মধ্যে ডানপিটে তুষার  মায়ের কাছে ছিলেন সবচেয়ে আদরের। দুষ্ট স্বভারের ছিল বলে সবচেয়ে বেশি বকাও দিয়েছেন তাকেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম বর্ষে প্রথম হওয়ার পর মেধাবী তুষারকে নিয়ে যখন স্বপ্ন বুনতে থাকলো তার পুরো পরিবার, তখনই ঘটলো দুর্ঘটনা। ভেঙে গেল স্বপ্ন, ভেঙে গেল মায়ের বুক। মা শান্তিলতা দাস টানা ১৩ দিন বাকরুদ্ধ ছিলেন।

আজ সেই শোকের দিন। ১৯৮৫ সালের আজকের দিনে (১৫ অক্টোবর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের একটি ভবন ধসে ৪০ ছাত্র-কর্মচারী নিহত হয়েছিলেন। সেই ট্র্যাজেডিতে তিন দিন শোক পালন করেছিল জাতি।

ওই সময় যারা নিহত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মার্কেটিং বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র নড়াইলের তুষার দাস। সন্তান হারানোর এত বছর পরও প্রায়ই তিনি সন্তানের হাতে আঁকা ছবি বুকে জড়িয়ে কাঁদেন, সন্তান শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন।

সন্তানের প্রসঙ্গ তুলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন শান্তিলতা দাস। মুখে কথা বেধে যাচ্ছিল। তখন পাশে থেকে তাকে সান্তনা দিচ্ছিলেন তার মেয়ে সুপ্রিয়া দাস। সুপ্রিয়া দাস বলছিলেন সেই হৃদয় বিদারক কাহিনী।

সুপ্রিয়া দাস বলেন, জগন্নাথ হলে যেদিন ট্রাজেডি ঘটে, নড়াইলে বসে তৎক্ষণাৎ খবর পাওয়ার উপায় ছিল না। কিন্তু মায়ের মন তো! সেদিন রাতে স্বপ্নের মধ্যেই সে চিৎকার করে ওঠে হঠাৎ, ‘হোস্টেল ভাইঙ্গা পড়ছে, হোস্টেল ভাইঙ্গা পড়ছে’। মায়ের চিৎকার শুনে তখন আমরা আমাদের বাড়ির পাশে একটা ছেলেদের হোস্টেল ছিল, সেখানে গিয়ে দেখলাম যে সেটা ঠিকই আছে। কিন্তু মাকে কিছুতেই শান্ত করা যাচ্ছে না, কিছুতেই তার উদ্বিগ্নতা কমছিল না।

সুপ্রিয়া সে ঘটনার পরের দিনে তার পরিবারের অবস্থা উল্লেখ করে জানান, সকালে ছোট দা’র(তুষার) খবর জানার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পেলাম না। আমাদের এক আত্মীয়ের বাসায় টেলিফোন ছিল, সেখানে গিয়ে ঢাকায় অন্য আত্মীয়ের সঙ্গে কথা বললে তারা জানালো জগন্নাথ হলের হোস্টেল ভেঙ্গে পড়ে অনেক ছাত্র মারা গেছে। তখন আমাদের উদ্বিগ্নতা আরও বেড়ে গেল।

তিনি আরও জানান, মা বারবারই বলছিল, আমার তুষার কেন, খোঁজ নিচ্ছে না। তখন তাকে সান্তনা দিলাম যে দাদা তো রাজনীতি করে তাই হয়তো সবাইকে সাহায্য করছে। চিন্তা কর না, দাদার কিছু হবে না। কিন্তু আমাদের অস্থিরতাও তখন বেড়ে যাচ্ছিল। সন্ধ্যার দিকে ডিসি অফিস থেকে লোকজন আসলো আমাদের বাড়িতে। তারা এসে খোঁজ খবর নিল, আমরা কেমন আছি। কিন্তু দাদার কথা কিছুই বললো না। ওদিকে ঢাকা থেকেও আমাদের আত্মীয়রা কোন খবর দিল না। শুধ বললো, অনেক ছেলে মারা গেছে।‘পরদিন সকালে মা পাগলপ্রায় হয়ে গেল, সে তখনই ঢাকা যাবে। তখন সারাদিনে নড়াইল থেকে একটি মাত্র বাস আসতো ঢাকায়। সেটিও তখন ছেড়ে গেছে। কিন্তু কিছুতেই তাকে মানানো যাচ্ছে না।

সেদিন বিকেল বেলা হঠাৎ করে মা বলে উঠলো, ‘আমার তুষার আইছে, তুষার আইছে’। বাড়ির বাইরে রাস্তায় গিয়ে দেখলাম একটি ট্রাক এসে ভিড়লো…(একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন সুপ্রিয়া নিজেও)।

পুজার ছুটিতে মাকে চিঠি লিখেছিলেন তুষার, ‘মা এবার পুজায় আসতে পারব না’। কিন্তু কে জানতো! না আসার কথা বলে সে না ফেরার দেশেই চলে যাবে! ৪০ টাকা দিয়ে একটি আঙটি কিনে পড়তেন তুষার। যে আঙটি আজও পরম যত্নে নিজের হাতে জড়িয়ে রেখেছেন শান্তিলতা দাস।’

কিন্তু পরিবারের সবচেয়ে বড় খুঁটিটি ভেঙে পড়লেও সবার সহযোগিতায় পথ হারায়নি শান্তিলতা ও মৃত শিবুপদ দাসের পরিবারটি। সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন অনেকেই। সান্তনা জানাতে পরিবারটির উদ্দেশ্য চিঠি লিখেছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও।

মেয়ে সুপ্রিয়া দাস তার দুই বছর পরই সুযোগ পায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে পড়ার। পাড়া প্রতিবেশীরা শান্তিলতাকে বলেছিলেন, ‘তোমার ছেলে যেখান থেকে লাশ হয়ে ফিরলো, সেখানে কোন সাহসে মেয়েকে পাঠাচ্ছো?’ কিন্তু দমে যাননি শান্তিলতা।

সুপ্রিয়া দাশ বলেন, আমি ভর্তি হওয়ার পরে ভাইয়ের সঙ্গে যারা রাজনীতি করতো সবাই আমাকে আগলে রাখতেন। সব সময় সহযোগিতা করতেন।

১৯৯৫ সালে পাশ করার পর ১৯৯৭ সালে সুপ্রিয়া একাউন্টস হিসেবে নিয়োগ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তার চাকরির জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন সেই সব মানুষের প্রতি যারা অগ্রণী ভুমিকা রেখেছিলেন। সুপ্রিয়া দাস এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট ম্যানেজার। মাকে নিয়ে থাকছেন ফুলার রোডের একটি কোয়ার্টারে। যার কয়েক গজ দূরেই জগন্নাথ হল; যেখানে দুর্ঘটনায় প্রাণ দিয়েছেন তার প্রিয় দাদা তুষার দাস।

১৫ অক্টোবর বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শোক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। স্মরণসভা, শোকর্যালী, বিভিন্ন উপাসনামূলক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সন্তান হারানোর শোকে মূহ্যমান বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার প্রতিবছর দিনটিকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে।


সর্বশেষ সংবাদ