বিশ্ববিদ‍্যালয় র‍্যাঙ্কিং মায়ের হাতের মোয়া নয়

প্রতিবছর যখন সারা দুনিয়ার ইউনিভার্সিটিগুলোর র‍্যাঙ্কিং হয়, আমাদের দেশে তখন দুই-চারদিনের জন‍্য একটা সাড়া পড়ে যায়। বাংলাদেশের কোন ইউনিভার্সিটি কেন বিশ্বমানের বিদ‍্যাপীঠের তালিকায় থাকে না, সেটা নিয়ে কানাঘুষা চলে। ক্ষোভে ও খেদে অনেকে এইসব তালিকাকে ফালতু মনে করে। অনেক তরুণ মনে করে, সারা জীবন যে প্রতিষ্ঠানের হাজারো সুনাম শুনে আসলাম, আজ সে প্রতিষ্ঠান বিশ্বমানে নেই—কী করে সম্ভব! যারা ইউনিভার্সিটিগুলো চালায়, তারা নানান ভাবে ব‍্যার্থতা ঢাকার জন‍্য সস্তা কথা বলতে থাকে। —তালিকায় থাকতে হলে, টাকা দিতে হয়। আমাদের সেই টাকা নেই। —তালিকায় থাকতে হলে তথ‍্য পাঠাতে হয়। যেহেতু আমরা “স্বাধীনতা ও সার্বভ‍ৌমত্ব” রাক্ষার মহান দায়িত্বে ব‍্যাস্ত, সুতরাং আমরা তথ‍্য পাঠাতে পারিনি। —কেউ কেউ বলবে, তালিকায় থাকতে হলে মোটা অঙ্কের ডোনেশন দিত হয়। এমনসব আজগুবি বানোয়াট যাচ্ছেতাই কথা বলে সপ্তাহ খানেক চলবে। তারপর যেই লাউ, সেই কদু!

বিশ্ববিদ‍্যালয় র‍্যাঙ্কিং বিষয়টাকে আমরা মায়ের হাতের মোয়া মনে করি। আমাদের তরুণদের যেহেতু বিষয়গুলো তেমন ধারণা দেয়া হয় না, তাই তারা ২২-২৪ বছর বয়সে বুঝতেও পারে না যে, একটা ইউনিভার্সিটি বিশ্বমানের হতে হলে কতো কতো ক্রাইটেরিয়া (বৈশিষ্ট‍্য) থাকতে হয়। দুনিয়ার যে ইউনিভার্সিটিগুলো সে তালিকায় থাকে, তারা ঘোড়ার ঘাস কাটে না। তাদের ক‍্যাম্পাসে দৌঁড়াদৌঁড়ি, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলে না। তাদের ক‍্যাম্পাসে, বাকসু হাগসু নির্বাচন নিয়ে রাষ্ট্র উলোট-পালট হয় না। তাদের ক‍্যাম্পাসের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার ঝুলে না। তাদের ক‍্যাম্পাসে নেতার শ্লোগান থাকে না। একটা ইউনিভার্সিটি বিশ্বমানের হওয়াটা নানার কাছে আবদার নয়, যে চাইলেই পাওয়া যাবে। বাঙালীর একটা ধারণা আছে—টাকা থাকলে বাঘের চোখ পাওয়া যায়। সুতরাং টাকা দিলে বেলতলী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ‍্যালয়কেও (বেবিপ্রবি) বিশ্বর‍্যাঙ্কিং-এ স্থান দেয়া যেতো।

একটা ইউনিভার্সিটি বিশ্বমানের কিনা, সেটার জন‍্য বেশ কিছু বিষয়কে আমলে নেয়া হয়। শিক্ষক : শিক্ষার্থীর অনুপাত, ইউনিভার্সিটির শিক্ষকদের যোগ‍্যতা, তাদের গবেষণার মান, বছরে পাবলিকেশনের সংখ‍্যা ও মান (কোয়ান্টিটি এন্ড কোয়ালিটি), আন্তর্জাতিকভাবে সেই পাবলিকেশনগুলো কতোটা পরিচিত (কী পরিমাণ সাইট করা হয়), অন‍্যান‍্য প্রতিষ্ঠানের সাথে গবেষণার কোলাবোরেশন ও বিদেশী শিক্ষার্থীদের সংখ‍্যা ইত‍্যাদি। বিশ্বের প্রথম চার-পাঁচশ ইউনিভার্সিটির তালিকায় থাকা কতো কঠিন বিষয় সেই ধারণা আমাদের তরুণদের নেই। কারণ তাদেরকে সেই ধারণটা দেয়া হয় না।

চীনের পিকিং ও সিংহুয়া ইউনিভার্সিটি হলো সে দেশের বেষ্ট ইউনিভার্সিটি। সিংহুয়া ইউনিভার্সিটি কী মানের গবেষণা করে, সেটা গবেষণার সাথে যারা জড়িতা তারাই ভালো জানে। সে ইউনিভার্সিটি এবার বিশ্বের ২৩ তম প্রতিষ্ঠান হয়েছে। গবেষণায় তাদের স্কোর একশোতে ৯৪! সিংহুয়া ইউনিভার্সিটিতে যদি কেউ শিক্ষকতায় ঢুকতে চায়, তাহলে তাকে হতে হয় ১৫০ কােটি মানুষের দেশের অন‍্যতম মেধাবী! “সহস্র মেধাবী প্রকল্পের” মাধ‍্যমে তারা চীনের সবচেয়ে মেধাবী ছেলে-মেয়েগুলোকে সেখানে শিক্ষক হিসেবে ঢুকায়। আপনি এমআইটি, অক্সফোর্ড কিংবা হার্ভাড থেকেও যদি পিএইচডি-পোস্টডক করে যান, তাহলেও যে আপনি সেখানে শিক্ষক হিসেবে ঢুকতে পারবেন, সে গ‍্যারান্টি আপনাকে কেউ দিতে পারবে না। কারণ শুধু বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানের ডিগ্রিই যথেষ্ট নয়, থাকতে হবে বিশ্বসেরা জার্নালে পাবলিকেশন। থাকতে হবে যুগপাল্টানো গবেষণার ধারণা। ইউনিভার্সিটি অব ক‍্যালগেরি কানাডার খুব নামকরা প্রতিষ্ঠান। অথচ সে প্রতিষ্ঠানটির তালিকা হলো ২০১-২৫০ এর মধ‍্যে। অর্থাৎ এতো এতো ভালো ও নামকরা প্রতিষ্ঠান আছে যে, দুইশ’র পর তালিকাটা একটা রেঞ্জে দেয়া হয়। একটা ক্লাসে যদি পাঁচশ স্টুডেন্ট থাকে, তাহলে রোল নম্বর ১-১০ এর পর বাকীদের মেধা যাচাইয়ে বলা হয়, প্রথম কুড়িতে কারা আছো। কুড়ি থেকে পঞ্চাশে কারা আছো! বিষয়টা এমন! যে প্রতিষ্ঠানটি তালিকায় দশম তার সাথে তালিকার কুড়িতম প্রতিষ্ঠানের হয়তো তেমন পার্থক‍্য নেই কিন্তু যেটা একশোতম সেটা সাথে পার্থক‍্য আছে। এই তালিকা গুলো হলো ওভারঅল। এটা ছাড়াও বিষয়ভিত্তিক বা ফ‍্যাকাল্টিভিত্তিক একটা র‍্যাঙ্ক থাকে। কারণ অনেক প্রতিষ্ঠান হয়তো ওভারঅল তালিকায় একশতম, কিন্তু সে প্রতিষ্ঠানের বায়োকেমেস্ট্রির রিসার্চ দুনিয়াতে খুব নামকরা। কেউ যেমন রোল নং দশ হয়েও, ভূগোলে সবোর্চ্চ নম্বর পেতে পারে।

আমার হাতে যদি আলাদিনের চেরাগ থাকতো, তাহলে আমি দেশের ছেলে-মেয়েদের পৃথিবীর পাঁচশত তম ইউনিভার্সিটিতে পাঠাতাম। পাঁচশত তম প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ, শিক্ষার মান, গভীরতা, জ্ঞানমুখর পরিবেশ দেখে আমাদের ছেলে-মেয়েরা বিস্মিত হতো। তাহলে তারা ধারণা করতে পারতো, দুনিয়ায় কতো কতো সেরা সেরা বিদ‍্যাপীঠ খুলে রাখা হয়েছে। বিশ্বামানের একটা বিদ‍্যাপীঠ তৈরি করা ও মান বজায় রাখা চাট্টেখানে কথা নয়। বিশ্বমানের অস্ত্র বানাতে পারলে কিংবা পারমাণবিক বোমা বানাতে পারলেই বিশ্বমানের বিদ‍্যাপীঠ তৈরি করা যায় না। পাকিস্তান সম্ভবত তার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ! অথচ দুনিয়ার বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশ সেটা পেরেছে। সিঙ্গাপুর পেরেছে। আমাদের দেশের সবেচেয়ে ক্ষুদ্রতম জেলার সমান সে দেশ। অথচ সে দেশের ইউনিভার্সিটি তালিকায় পঁচিশতম স্থান করে নিয়েছে। বিষয়টা মায়ের হাতের মোয়া নয়!

বিশ্বমানের বিদ‍্যাপীঠের জন‍্য বিশ্বমানের পরিকল্পনা লাগে। দায়সারা কথা বলে, নিজেদের ভুলগুলোকে না শুধরিয়ে যদি মান পরিবর্তনের জন‍্য উঠে-পড়ে না লাগে, তাহলে পৃথিবীর কিছু আসে যায় না। যারা এগিয়ে যাওয়ার তারা যাচ্ছেই। কূপমণ্ডুকের মতো আবেলা-তাবোল বলা যাবে, তাতে বিশ্বমানের বিদ‍্যাপীঠ তৈরি করা যাবে না।

লেখক: রউফুল আলম
নিউজার্সি, যুক্তরাষ্ট্র।

বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিং দেখতে ক্লিক করুন...


সর্বশেষ সংবাদ