গেস্টরুম-গণরুম নির্যাতনের প্রতিবাদে জেগে উঠছে ঢাবি ছাত্ররা

  © ফাইল ফটো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেস্টরুম একটি আতংকের নাম। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেস্টরুম-গণরুম সবসময়ের জন্য একটি আলোচিত বিষয়। খবরের কাগজ বা সাময়িক বা মাসিক ম্যাগাজিনে খুললেই চোখেঁ পড়ে গেস্টরুম গণরুমের বিভৎস নির্যাতনের সংবাদ।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, বাসায় গেস্ট বা অথিতি আসলে তাদের নানাভাবে আপ্যায়ন করা হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নবাগত শিক্ষার্থীদের আপ্যায়নের নামে গেস্টরুম বা গণরুমে চালানো হয় নির্যাতন। এই গেস্টরুমে হলের সিনিয়রদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে কেউ ছেড়েছেন হল, কারোর নষ্ট হয়েছে নিজের শরীরের কোন অংগ। এমনই অভিযোগ ঢাবির প্রথম বর্ষে হলে অবস্থান করা অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা।

হলে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে থাকায় হলে গেস্টরুম-গণরুম নির্যাতন নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক কাজে বাধ্য করানোর জন্য এই গেস্টরুম-গণরুম নির্যাতন। কয়েকদিন পরপরই গেস্টরুম-গণরুম নির্যাতন বিভিন্ন প্রত্রিকার শিরোনামে হচ্ছে। সবার দাবি এই গেস্টরুম-গণরুম নির্যাতন বন্ধ করার।

তবে গেস্টরুম-গণরুম নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগের শেষ নেই। অথচ এর দায় নিতে চান না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের। বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমাদের কাছে অভিযোগ দিলে আমরা ব্যবস্থা নিব। অভিযোগ না পেলে আমরা কীভাবে ব্যবস্থা নেব।’

অথচ এই গেস্টরুম-গণরুম নির্যাতনে ২০১৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারী বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলের এহসানকে নির্বিচারে মারধর করে চোখের কর্নিয়া ক্ষতিগ্রস্ত করে দেয় ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা। এহসানের একটি চোখের কর্নিয়া গুরুতর জখম হয় । পওে তাকে ভারতে চোখে অস্ত্রোপচার করানো হয়। ভারত থেকে চিকিৎসার পর ভাল হয়ে ক্যাম্পাসে ফিরে আসা এহসান ফের মারের আংশকায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগলেও বহিষ্কৃত ছাত্রলীগের তিন নেতা-কর্মী হলে ছিলেন বহলা তবিয়তে।

এহসানকে মারের কারন অনুসন্ধান করে দেখা যায়,এহসানের কাছ থেকে একটি ক্যালকুলেটর ধার নিয়েছিলেন বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতা ওমর ফারুক। পরে তা ফেরত চাওয়ায় গভীর রাতে শুরু হয় এহসানের উপর মারধর । পরে, শিবির কর্মী হিসেবে স্বীকারোক্তি আদায়ে আরও এক দফা পেটানো হয়। সড়ক দুর্ঘটনায় আহতের কথা বলে চিকিৎসা করার পর আবার এহসানকে এসএম হল ছাত্রলীগের সভাপতি তাহসান রাসেলের কক্ষে নেয়া হয়। এরপর সকালে চোখের অবস্থা আবার খারাপ হলে আরেক দফা ঢাকা মেডিকেল নিয়ে চিকিৎসা করানো হয়।

পরে আবার হলে ফিরিয়ে নিয়ে ছাত্রলীগ নেতার কক্ষে রাখা হয়। গভীর রাত থেকে দুপুর পর্যন্ত কোনো খাবার দেয়া হয়নি তাকে। এরপর এহসান কৌশলে পালিয়ে এসে বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতিতে গিয়ে অভিযোগ করেন। এহসানের মত এমন শত শত মর্মান্তকি ষটনা আছে গেস্টরুম-গণরুম ঘিরে । একই হলের ৯৭জন ছাত্রকে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল গভীর রাতে।

মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের গেস্টরুমে ২০১৮ সালে এক সাথে ৩০জনকে মারা হয়েছিল। এছাড়া ২০১৯ সালেও একসাথে ২৫ জনকে মারা হয়। এভাবে অধিকাংশ হলেই গেস্টরুম নির্যাতনের দৃষ্টান্ত রয়েছে।

তবে, সাম্প্রতিককালে গণরুম-গেস্টরুমে নির্যাতনের প্রতিবাদে সোচ্চার হচ্ছেন নির্যাতিত শিক্ষার্থীরা। হলের সিনিয়ররা আচরণ শেখানোর নামে গেস্টরুম নিয়ে নির্যাতন করার চেষ্টা করলে প্রতিবাদে সিনিয়রদের ছাড় দিচ্ছেন না তারা।

কয়েকদিন আগে আগে,ব্যক্তিগত কাজ থাকার কারণে মধুর ক্যান্টিনে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে না যাওয়াকে কেন্দ্র করে রাতে মনিরুল ইসলামকে গেস্টরুমে মারতে শুরু করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। পরে, মনিরুল মার সহ্য করতে না পেরে হলে ছাত্রলীগের কর্মীদের ‘কুত্তার বাচ্চা’ বলে গালি দেন। যারা তাকে মেরেছিল তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইনের অনুসারী।

অন্যদিকে, গত বুধবার রাতে সূর্যসেন হলে গেস্টরুমের মার সহ্য করতে না পেরে এক সিনিয়রকে কামড়ে দেন এক জুনিয়র। পরে জানা যায়, সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের রুখতে বুধবার ভোরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। তবে ওই শিক্ষার্থী এতে অংশ না নিতে ইমিডিয়েট সিনিয়রদের নিকট থেকে ছুটি না নিয়ে বেশি সিনিয়রদের কাছ থেকে ‘ছুটি’ নেন।

এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত ও সূর্যসেন হলের সংযুক্ত শিক্ষার্থী আবু সাঈদের উপর ক্ষিপ্ত হন মাস্টারদা’ সূর্যসেন হলের ছাত্রলীগ কর্মী আরাফাত হোসেন অভি। এক পর্যায়ে সাঈদকে হলের ২৩৭ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে চড়-থাপ্পড় মারেন অভি। তবে তা সইতে না পেরে অভিকে পালটা অভিকে থাপ্পড় দেয় সাঈদ। এসময় অন্যরাও নির্যাতন শুরু করলে অভিকে কামড় দেয় সাঈদ।

এ ধরনের প্রতিবাদকে সমর্থন করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা । তাদের মতে. গেস্টরুম-গণরুম নির্যাতনের প্রতিবাদ তেমন হয় না। যে কারণে এ ধরনের নির্যাতন বেড়েই চলছে। নির্যাতন করার কারণে ধ্বংস হচ্ছে হাজারো শিক্ষার্থীর স্বপ্ন। যদি নির্যাতিতরা এভাবে প্রতিবাদ করতে থাকে তাহলে হয়ত এই নির্যাতনের প্রতিরোধ সম্ভব।

এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের এক আবাসিক ছাত্র বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাইলে এই প্রথা বন্ধ করতে পারে। আমরা ভয়ের কারণে কাউকে কিছু বলতে পারি না। প্রশাসন চাইলে খোঁজ নিয়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। কারণ সবকিছু তাদের হাতের লাগালেই হয়। পারিবারিক অসচ্ছলতার কারনে হলে থাকি । কিন্তু এই সুযোগে ছাত্রলীগ আমাদের জগন্য ভাবে ব্যবহার করে।’

অন্যদিকে ডাকসু চাইলে এটিকে বন্ধ করা সম্ভব বলে অনেকে মনে করছেন। কিন্তু ডাকসুর নেতারা শুধু প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ অনেক ছাত্রের। কারন, তারাও এখনও কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে তেমন কোন কর্মসূচি দেননি।

এ ব্যাপারে ডাকসুর সহ সভাপতি (ভিপি) নুরুল হক নুর দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘হলে বর্তমানে যে অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা আছে, এজন্য অনেকাংশে দায়ী ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ। মেধার ভিত্তিতে সিট নিশ্চিত করা, গেস্টরুম-গণরুম বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না তাদের জন্যে। কারণ অছাত্ররা থাকে ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায়। গনরুম গেষ্টরুম চালায় ছাত্রলীগ।’

তিনি বলেন, ‘তারা নির্বাচনের আগে বলেছিল এগুলো পরিবর্তন করবে। আমরাও বলেছিলাম, এটা ভালো উদ্যোগ। নির্বাচন যে প্রক্রিয়াতেই হোক তারা যেহেতু ডাকসুতে আসছে, তাই আমরা ভেবেছিলাম তারা তাদের নির্বাচনী যে ইশতেহার, সেগুলো তারা তা বাস্তাবায়ন করবে। ডাকসু বা হল সংসদকে কার্যকর করতে কাজ করবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘ছাত্রলীগের আগের যে কার্যক্রম বা ধারা ছিল এখনো সেগুলো আছে। আমরা চাই ছাত্রলীগের বাইরে যারা আছে তাদের নিয়ে কাজ করতে। ছাত্রলীগ বলে যে, তারা কাজগুলো বাস্তবায়ন করবে, কিন্তু আমরা বাস্তবে তেমনটা দেখতে পারছি না।’

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক এবং ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম হোসেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমি মনে করি, আবাসন সংকটের স্থায়ী সমাধান ছাড়া রাজনীতিতে স্থায়ীভাবে যে নেতিবাচক সমস্যাগুলো ঢুকে গেছে সেগুলো থেকে মুক্তি পাওয়া কিছুটা দূরহ। তারপরেও ছাত্রলীগের প্রচেষ্টা রয়েছে রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে আরো উন্নত করার, রাজনৈতিক সহনশীলতা বাড়ানোর। শিক্ষার্থীর মধ্যে পারস্পরিক সহমর্মিতা বাড়ানোর।’

তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের প্রথম পরিচয়, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং সুনির্দিষ্ট কোন একটি ছাত্র সংগঠনের কর্মী। যেহেতু বাস্তবতার কারণে গণরুমে একজন শিক্ষার্থী থাকছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে থাকবে এইটুকু আমরা নিশ্চিত করতে চাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী কোন সংগঠনের কর্মী হিসাবে নয়, একজন শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় থাক।’

এসময় গেস্টরুম কেন বন্ধ হচ্ছে না এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম চলে আলাপ, আলোচনা,মিটিং পাঠশালা এগুলোে মধ্য দিয়ে।’


সর্বশেষ সংবাদ