অধিভুক্তি বাতিল হলে ‘ঢাকা অচল’ আন্দোলন!

সেশনজট, গণহারে ফেল, নিজস্ব প্রশাসনিক ভবন এবং রুটিন প্রকাশ— এমন নানা দাবি নিয়ে ক’দিন পরপরই আন্দোলনে নামা সাত কলেজের সমস্যা যেন সমাধান হওয়ার নয়। দু’বছরের বেশি সময় ধরে ‘অধিভুক্তি সমস্যা’ চলে আসলেও নতুন বিপত্তিটা ঘটেছে অন্যখানে। সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের চাওয়া— অধিভুক্তি বহাল রেখে সব ধরণের সমস্যা সমাধান হোক, যদিও ঢাবি শিক্ষার্থীদের দাবি, কলেজগুলোকে আলাদা করে চলমান সংকট নিরসন। অর্থ্যাৎ ভিন্ন দুই দাবি নিয়ে উভয় পক্ষ আন্দোলনে যাওয়ায় ‘বড় ধরণের সংকট’ তৈরি হয়েছে উচ্চশিক্ষার এই খাতটিতে।

বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবিলম্বে এই সমস্যা সমাধান না হলে যে কোনো সময় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পাশাপাশি অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির সম্ভাবনাও রয়েছে। সবার উচিত- শান্তিপূর্ণ সমাধানে আসা।

জানা যায়, ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর সাত সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত করা হয়। এগুলো হচ্ছে-ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ। অধিভুক্ত হওয়ার পর থেকেই নানা সংকট লেগেই আছে এসব কলেজের। ফলে লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে। এ কারণে তারা কখনও পরীক্ষার রুটিন, কখনও ফলের দাবিতে রাজধানীর নীলক্ষেত ও শাহবাগের মোড় অবরোধ করছে শিক্ষার্থীরা। এ আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে তিতুমীর কলেজের আবু বকর সিদ্দিক নামে এক শিক্ষার্থী চোখও হারিয়েছে। তবুও সুফল পায়নি সাত কলেজের লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর। তাই বারবার রাস্তায় নামতে বাধ্য হচ্ছে তারা।

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের মধ্যেই আগামী ১৫দিনের মধ্যে সংকট দূর করার আশ্বাস দিয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জান। বলেছেন, অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সাত কলেজের অধিভুক্তি হয়েছে। তাই সাত কলেজের সুষ্ঠু সমাধান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থ রক্ষা হয় এই জন্য বৈজ্ঞানিক উপায়ে এটির সমাধান করা হবে। এছাড়া সাত কলেজের সমস্যা সমাধানে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানান ঢাবি উপাচার্য।

অন্যদিকে উপাচার্যের বক্তব্যের পর চলমান আন্দোলনের নেতারা বলেছেন, অধিভুক্ত ইস্যুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটির সিদ্ধান্ত সাত কলেজবিরোধী হয়, তবে তা কোনভাবেই মানা হবে না। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে আলাপকালে এই হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন কয়েকজন নেতা। ঢাবি প্রশাসন অধিভুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিলে সাত কলেজের অবস্থান কি হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে আন্দোলনের সমন্বয়ক ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী এ কে এম আবু বকর বলেন, অধিভুক্তি যদি বাতিল করতেই হয়, তবে আমাদের দুই বছরের যে সেশন জটিলতা হয়েছে অর্থ্যাৎ আমাদের শিক্ষা জীবনের পিছিয়ে যাওয়া বছরগুলো ফিরিয়ে দিতে হবে।

তার হুশিয়ারি— অধিভুক্তি প্রশ্নে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যৌক্তিক সমাধানে না এসে হঠকারি সিদ্ধান্তের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়, তবে শুধু নীলক্ষেত না, ‘ঢাকা অচল’ আন্দোলনে নামবে আড়াই লাখ শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, আমরা যে সাধারণ শিক্ষার্থী সবাই তা ভুলে গিয়ে একবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, আরেকবার ঢাবিতে নিচ্ছে। ভবিষ্যতে সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের জীবন বিপন্ন করার সুযোগ দেওয়া হবে না।

আবু বকর বলেন, সাত কলেজের প্রত্যেকটি নিজেদের আলাদা আলাদা বিশেষ ঐতিহ্যে আছে। সুতারাং কালক্ষেপন এবং হঠকারিতামূলক সিদ্ধান্ত না নিয়ে যৌক্তিক সমাধানের মাধ্যমে প্রত্যেকের ন্যায্য প্রাপ্ততা বুঝিয়ে দেওয়া উচিত।

ঢাবি অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজ ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক তালুকদার মুহাঃ ফজলুল করীম অপূর্ব মনে করেন, বাতিল না করে আমাদের আলাদা প্রশাসন দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করুক। সবকিছু কলেজ কর্তৃক পরিচালনা হোক, ঢাবি শুধু সনদপত্র প্রদান করুক। কারণ কোন কলেজ সনদ প্রদান করার ক্ষমতা রাখে না। আর ঢাবির অন্য অধিভুক্ত কলেজগুলো যেভাবে পরিচালনা হয়, সেভাবে আমাদের পরিচালনা করুক। তাহলেই কারো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এমতাবস্থায় আমাদের অধিভুক্তি বাতিল করলে সকল সেশন ব্যাপক সমস্যা পড়ে যাবে, এমনও হতে পারে দেড়-দুই বছরের সেশনজটে পড়ব।

আন্দোলনে নেতৃত্বে দেওয়া ঢাকা কলেজ মাস্টার্সের শিক্ষার্থী বিএম শাহীন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ব্যবস্থা দুর্বল সেক্ষেত্রে প্রশাসনিক ব্যবস্থা বৃদ্ধি করে একটা সমাধান হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত প্রত্যেকটা ডিপার্টমেন্টের রেজাল্ট ভুলে ভরা। কেউ পরীক্ষা দিয়েও রেজাল্ট পাচ্ছে না, আবার কেউ পরীক্ষা না দিয়েই ভালো রেজাল্ট করছে। মূলত অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন স্বল্প সংখ্যক প্রশাসনিক ব্যবস্থা দিয়ে সামাল দেওয়া সত্যি কঠিন কাজ।

অধিভুক্তি বাতিল চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঢাবির আন্দোলন নিয়ে আমাদের কোন মাথা ব্যথা নেই। বরং আমরা আমাদের দাবিগুলোই ফোকাস করছি। আমরা যে সমস্যায় ভুগছি, আমাদের যে দাবিগুলো ছিলো সেগুলো এখনো বলবৎ আছে। তার ভাষ্য, তারা (ঢাবি শিক্ষার্থীরা) বলছে তাদের টিচাররা আমাদের নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তাদের নিজেদের সমস্যা হচ্ছে। তাহলে তো কথা পরিস্কার, আমাদের জন্য আলাদা প্রশাসন এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা করে দেয়া হোক; যাতে করে তাদের শিক্ষকরা আমাদের নিয়ে আর ভাবতে না হয়।

অধিভুক্তি বাতিল চান না অধ্যক্ষরাও
শুধু শিক্ষার্থী নয়, কলেজ অধ্যক্ষরাও চান না সাত কলেজ অধিভুক্তি বাতিল হোক। ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর নেহাল আহমেদ বিষয়টির ইঙ্গিত দিয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমাদের কার্যক্রম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তদারকি করছে, যে কারণে শিক্ষার্থীরা আগের চেয়ে বেশি ক্লাসমুখী। সাত কলেজের প্রায় প্রত্যেকটি বিষয়টি প্রচন্ড চাপের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে; কারণ শিক্ষার্থীরা ক্লাসমুখী হয়েছে। তবে আবকাঠামো এবং শিক্ষক সংকট বড় সমস্যায় পরিণত হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে সাত কলেজের আরেক অধ্যক্ষ বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ার পর এসব কলেজে শিক্ষার গুণগত মান বেড়েছে। সে হিসেবে অধিভুক্তি বাতিল চাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। তবে অন্যান্য পরিমাণগত মান বাড়েনি। তিনি বলেন, একদিকে ক্লাসে উপস্থিত থাকার বাধ্যবাধতা করা হয়েছে, কিন্তু ব্যাপক অকৃতকার্য হচ্ছে। আমরা চাই অধিভুক্তি বহাল রেখে এসব সমস্যার দ্রুত সমাধান হোক।

সামাগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাবি ভিসি অধ্যাপক ড. মো: আখতারুজ্জামান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সাত কলেজ অধিভুক্ত করার সময়ই কিছু জটিলতা রাখা হয়েছে। যা বিজ্ঞানসম্মত নয়। নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে। আশা করি দ্রুতই একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব হবে। এর আগে তিনি সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, শিক্ষার্থীরা যে দাবি রয়েছে তা মেনে নেওয়া হবে।

সমস্যা সমাধানে ১০ সদস্যের কমিটি
এদিকে সাত কলেজ নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে ইতোমধ্যেই ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি সুপারিশ কমিটি গঠন করেছে ঢাবি। বুধবার ঢাবির প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদকে আহ্বায়ক করে এই কমিটি গঠন হয়।

কমিটির উল্লেখযোগ্য সদস্যরা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম, কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আবু মো. দেলোয়ার হোসেন, বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. তোফায়েল আহমদ চৌধুরী, ঢাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল, ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ, ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ প্রমুখ। এছাড়া কমিটির সমন্বয়ক করা হয়েছে- ডাকুসুর ভিপি নুরুল হক নূর ও জিএস গোলাম রাব্বানীকে। কমিটিকে আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে কলেজ অধিভুক্তির বিষয়ে সুপারিশ দিতে বলা হয়েছে।

এর আগে ১৫ দিনের মধ্যে সাত কলেজের সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। বুধবার দুপুরে সাংবাদিকদের এ কথা জানান। তিনি বলেন, অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সাত কলেজের অধিভুক্তি হয়েছে। তাই সাত কলেজের সুষ্ঠু সমাধান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থ রক্ষা হয় এই জন্য বৈজ্ঞানিক উপায়ে এটির সমাধান করা হবে।

ঢাবির অধিভুক্তি বাতিল আন্দোলন চলবে
এদিকে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র শাকিল মিয়া।

তিনি বলেন, আমাদের দাবি হচ্ছে সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল। আমরা আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবো। তিনি আরো বলেন, আমাদের দাবী যদি না মানা হয় এবং আবার যদি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে তাহলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তার সমুচিত জবাব দেবে।

আন্দোলনকারীদের আরেকজন আকরাম হোসেন বলেন, ‘ঢাবি আদেশ ১৯৭৩ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় চাইলে অধিভুক্তি বাতিল করতে পারে এবং আমরা এজন্যই আন্দোলন করছি। আমাদের এ আন্দোলন কর্মসূচি ছিল সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ। কিন্তু গতকাল ছাত্রলীগ আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে হামলা চালিয়েছে।'

পড়ুন:রেনু হত্যাকারী হৃদয় সবজি বিক্রেতা, বাবা-মা নেই, থাকতেন নানীর কাছে


সর্বশেষ সংবাদ