আয়মান চাইলে নিরাপত্তা দেবে পুলিশ: ডয়েচে ভেলের দীর্ঘ প্রতিবেদন

  © ফাইল ফটো

ফেসবুকে সাবেক এক কর্মীর পোস্ট করা সমকামি বিষয়ক একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে অনলাইন শিক্ষা বিষয়ক প্লাটফর্ম ‘টেন মিনিট স্কুল’-এর প্রতিষ্ঠাতা আয়মান সাদিককে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। এই হুমকিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া উচিত বলে মনে করছে অধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো।

আয়মান সাদিক ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ফোরবস ম্যাগাজিনের ‘৩০ আন্ডার ৩০ এশিয়া’ অর্থাৎ এশিয়ায় ৩০ বছরের কম বয়সী ৩০ জনের তালিকায় ঠাঁই পান। তার প্রতিষ্ঠিত ওয়েবসাইটে হাজার হাজার তরুণ শিক্ষার্থী ভিজিট করেন। এখানে নারীদের ঋতুস্রাব এবং শারীরিক সম্মতি বিষয়ক ভিডিও প্রকাশ করার কারণেও তিনি সমালোচিত। ইসলামপন্থিরা এর প্রতিবাদ ও হুমকি দেয়ার পর ওইসব ভিডিও তার ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। অনলাইন ডয়েচে ভেলেতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।

এতে আরো বলা হয়- ইসলামপন্থিরা মনে করেন, ওইসব পোস্ট তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের বিপরীত। এর পরপরই এসব পোস্টের জন্য ক্ষমা চায় সাইটটি।

একই সঙ্গে প্রত্যয় ঘোষণা করে তারা কারো ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত হানবে না। সম্প্রতি প্রকাশিত এক ভিডিও বার্তায় আয়মান সাদিক হত্যা হুমকি পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। বিশেষ করে ফেসবুকে সমকামি বিষয়ক পোস্ট দেয়ার জন্য তাকে এই হুমকি দেয়া হয়েছে। তিনি এক বিবৃতিতে লিখেছে, টেন মিনিট স্কুলের কোনো প্রোপাগান্ডা নেই। নেই কোনো গোপন এজেন্ডা বা আলাদা কোনো ধর্মীয় বিশ্বাস। ‘আমরা ধর্মপ্রচার করি না। ইসলামবিরোধী কিছু করতে চাই না আমরা। ভবিষ্যতে তা করারও কোনো পরিকল্পনা নেই আমাদের।’

ডয়েচে ভেলে আরো লিখেছে, ইউটিউবে পোস্ট করা হুমকির বিষয়ে তিনি একটি ভিডিও বিবৃতি দিয়েছেন। তাতে বলেছেন, আমার মা আমাকে ইউটিউবে ওইসব ভিডিও দেখিয়েছেন, যেখানে তার একমাত্র ছেলেকে হত্যার আহ্বান জানানো হচ্ছে। আমি জানি না এমন অবস্থায় কেমন অনুভূতি হয়। বাসায় আমার মা বাবা ও আমি প্রত্যেকেই প্রতিক্ষণ সবাই নিরাপদ আছি কিনা তা নিশ্চিত করছি। এমনই এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে আমার বাসায়।

ডয়েচে ভেলে আরো লিখেছে, প্রায় ১৬ কোটি ১০ লাখের বেশি মানুষের বাংলাদেশে শতকরা প্রায় ৯০ ভাগই মুসলিম। বিশেষজ্ঞরা বলেন, রক্ষণশীল এই দেশে সমকামিতার মতো ইস্যু নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনার কোনো স্থান নেই। কয়েক বছরে কিছু সংখ্যক অধিকারকর্মী এ ইস্যুতে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য চেষ্টা করেছিলেন। ফলে ধর্মীয় কট্টরপন্থিরা তাদেরকে হত্যা করেছে, না হয় হত্যার হুমকি থাকায় তারা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।

২০১৫ সালে ঢাকায় অভিজিত রায়ের ওপর হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। ওই হামলায় তার স্ত্রী বন্যা আহমেদ মারাত্মক আহত হন। বন্যা বিশ্বাস করেন, ধর্মীয় কট্টরপন্থিদের সব হুমকিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া উচিত। সমকামিতা বিষয়ক একটি বই প্রকাশের পর হত্যা করা হয়েছে অভিজিত রায়কে। ডয়েচে ভেলেকে বন্যা আহমেদ বলেন, ২০১৫ সালে অন্য অনেক ব্লগার, প্রকাশক ও ধর্মনিরপেক্ষ বোদ্ধা ও আমাদের সঙ্গে যা ঘটেছে, তারপরে কিভাবে আমি বলতে পারি যে- এসব হুমকিকে গুরুত্ব দিয়ে নেয়া উচিত নয়? অবশ্যই আয়মান সাদিককে এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে নেয়া উচিত।

সমকামিতার চিন্তাধারার কথা প্রকাশ করার কারণে ২০১৩ সালে ঢাকায় হামলা হয় আসিফ মহিউদ্দিনের ওপর। তারপর তিনি জার্মানিতে নির্বাসনে বসবাস করছেন। তিনি ডয়েচে ভেলে’কে বলেন, ২০১৬ সালে বাংলাদেশের দু’জন সুপরিচিত এলজিবিটি অধিকারকর্মী জুলহাস মান্নান ও মাহবুব রাব্বি তনয়কে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। তারপর থেকে মূলধারার মিডিয়া ও দেশের বেশির ভাগ সেলিব্রেটি ইসলামপন্থিদের বিষয়ে খুবই ভীত হয়ে উঠেছেন। তিনি আরো বলেন, আয়মান সাদিক ও তার সহকর্মীদের ছবি দেখেছি অনেক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্টে। সেখানে লোকজন লিখেছেন, ইসলামের রীতি ভঙ্গ করার কারণে এসব ব্যক্তিকে অবিলম্বে হত্যা করা উচিত। তাই এই হুমকিকে গুরুত্ব দিয়ে নেয়া উচিত।

বন্যা আহমেদ এবং আসিফ মহিউদ্দিন বলেছেন, যেসব ব্লগার ও অধিকারকর্মী উন্মুক্ত কথাবার্তা বলে, ওইসব ব্লগার ও অধিকারকর্মীর নিরাপত্তা দিচ্ছে না সরকার। বন্যা আহমেদ প্রশ্ন রাখেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হত্যার হুমকি দেয়ার কারণে কাউকে বাংলাদেশ সরকার গ্রেপ্তার করেছে এমনটা আপনি কখনো শুনেছেন? পক্ষান্তরে, সরকার যদি এসব মানুষকে সমর্থন করে তখন আমরা বিস্মিত না হয়ে পারি না। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের নজরদারির অধীনে ইসলামপন্থি কট্টরপন্থিরা অধিক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।

আসিফ মহিউদ্দিনও বিশ্বাস করেন, ইসলামপন্থিদের জন্য সরকার এটা পরিষ্কার করে দিয়েছে যে, ধর্মনিরপেক্ষ লেখক অথবা অধিকারকর্মীর ওপর হামলার জন্য তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে না। আসিফ বলেন, মানবতার পক্ষে নিরাপত্তা দেয়ার পরিবর্তে কর্মকর্তারা মাঝেমধ্যে বলে থাকেন, উগ্র ইসলামপন্থিদের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত ভিকটিমের। যখন পুলিশের কাছ থেকে সাহায্য চেয়েছিলেন ব্লগার নিলয় নীল, তখন তারা তাকে বলেছিলেন, এসব লেখালেখি বন্ধ করে দেশ ছাড়তে। পরে তাকে ধর্মীয় উগ্রপন্থিরা হত্যা করে।

আয়মান সাদিকের বিরুদ্ধে হুমকির বিষয়ে কর্তৃপক্ষ অবহিত বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট। তারা আরো বলেছে, অপরাধীদের খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছে। ইউনিটের উপ কমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেছেন, এই হুমকির নেপথ্যে কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপ আছে কিনা আমরা তা তদন্ত করে দেখছি। যদি আবেদন করা হয় তাহলে পুলিশ তাকে নিরাপত্তা দেবে।


সর্বশেষ সংবাদ