‘মুসলমান হওয়ার গর্বে মাটিতে লোকের পা পড়ে না’

সংগীতশিল্পী এ আর রহমানের কন্যা খাতিজা রহমানের বোরখা নিয়ে আমার মত প্রকাশ করার পর খাতিজা আমাকে লিখেছেন যে আমি যেন ‘সত্যিকার নারীবাদ’ কাকে বলে তা গুগল করে জেনে নিই। আমি কি খাতিজাকে বলতে পারি না, ‘সত্যিকার ইসলাম’ কাকে বলে তাও যেন তিনি গুগল করে জেনে নেন। স্ত্রী অবাধ্য হলে কী করে স্বামীরা পেটাবে, কী করে এক দুই তিন করে চারটি বিয়ে করবে স্বামী, কী করে মেয়েদের ভাগে সম্পত্তি কম দেবে ইত্যাদি।

খাতিজা বলছেন বোরখা বা নিকাব তিনি পরেন কারণ এটা তাঁর ইচ্ছে। মেয়েরা তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী পোশাক পরবে, এতে আমার আপত্তি থাকার কথা নয়। খাতিজা কি জানেন অনেক মেয়েই তাদের ইচ্ছেয় বোরখা পরে না, পরে অন্যের ইচ্ছেয়? বাপ-ভাইয়ের, বা শ্বশুরবাড়ির ইচ্ছেয়! আজকাল তো আবার মেয়েদের কিছু ইস্কুল-কলেজও, কিছু অফিস-টফিসও আইন করে দিয়েছে সব মেয়েকেই হিজাব পরতে হবে। অনেক দেশেই হিজাব বা বোরখা না পরার স্বাধীনতা নেই। অনেক দেশেই জিন্স বা ট্রাউজার পরার স্বাধীনতা নেই। পরলে, নীতি-পুলিশেরা রাস্তাঘাটে মেয়েদের পেটায় । ভারতবর্ষের মেয়েদের পোশাকের ব্যাপারে কড়া আইন নেই বলেই খাতিজা পোশাক পরার স্বাধীনতার কথা বলতে পারেন। আমি জানি না, বোরখা পরার ইচ্ছের ব্যাপারে যত তিনি সচেতন, তত বোরখা না পরার ইচ্ছের ব্যাপারে তিনি ততটাই সচেতন কি না। তিনি কি কখনও সেইসব মেয়ের পাশে দাঁড়িয়েছেন, যাদের ইচ্ছে নেই বোরখা পরার, কিন্তু রাষ্ট্রের সমাজের পরিবারের চাপে বাধ্য হয়ে পরছে?

নিরাপত্তার কারণে ইউরোপের কিছু দেশ মুখ ঢাকা বোরখা নিষিদ্ধ করেছে। চোর, ডাকা্‌ত, জেল পালানো আসামী, ক্রিমিনাল, সন্ত্রাসী খুনী পুরুষকে বোরখার আড়ালে লুকিয়ে থাকতে দেখা গেছে, সে কারণে বোরখা পরো ক্ষতি নেই, মুখ ঢেকো না, ঢাকলে জরিমানা দিতে হবে এই আইনটি জারি করা হয়েছে। কিন্তু এই আইনটি থাকা সত্তেও যে মহিলারা মুখ ঢাকছে, তাদের কিন্তু পুলিশেরা পেটাচ্ছে না।

আমরা কি লক্ষ করছি না স্বাধীনতা শুধু এক পক্ষই ভোগ করছে। যারা নামাজ পড়তে চায়, তাদের জন্য মসজিদ বানানো হয়েছে যেন সেখানে গিয়ে নামাজ পড়তে পারে, মসজিদে জায়গা না হলে রাস্তা বন্ধ করে হলেও, যান জট ঘটিয়েও, পথচারীদের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে হলেও নামাজ পড়ার স্বাধীনতা তারা ভোগ করে। আজকাল নামাজ না পড়ার স্বাধীনতা কমে গেছে অনেক। গ্রামে তো লোকেরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নেয় কারা নামাজ পড়তে মসজিদে যায়নি, যারা যায়নি, তাদের একঘরে করে দেওয়া হয়। রোজা রাখার স্বাধীনতাও মানুষ ভোগ করে, কিন্তু যারা রোজা রাখতে চায় না, তাদের কি আদৌ স্বাধীনতা আছে রোজা না রেখে ঘরের বাইরে দিন দুপুরে নিশ্চিন্তে খাওয়া দাওয়া করার?

আজ মসজিদে, মাদ্রাসায়, ওয়াজে, মাহফিলে ইসলাম প্রচার হচ্ছে। মোল্লাদের যেমন ইচ্ছে যেভাবে ইচ্ছে কোরান হাদিসের ব্যাখ্যা করছে। দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ সেসব শুনছে, কিন্তু ইসলামের সমালোচনা করার স্বাধীনতা কারো আছে কি? তাহলে ধড়ে মুন্ডুটি থাকবে না। সে কারণেই বলছি স্বাধীনতা শুধু এক পক্ষের। যারা ধার্মিক, তাদের। যারা ধার্মিক নয়, তাদের কোনও স্বাধীনতা নেই। তারা আজ মুখ বন্ধ করে রাখে। নয়তো তারা কারাগারে, নির্বাসনে, নয়তো নিহত।

তাহলে কি ধার্মিকদেরই শুধু যেমন ইচ্ছে তেমন ভাবে কথা বলার, কাজ করার, বাঁচার অধিকার আছে, এবং অধার্মিকদের তা নেই? একটি গণতন্ত্র কি যে ধর্ম মানে, এবং যে মানে না, দু’জনের অধিকারকে সমান ভাবে দেখে না? সমান ভাবেই কিন্তু দেখা উচিত। গণতন্ত্র মানে কি এক ধর্মগোষ্ঠীকে উৎসাহ দেওয়া, এক ধর্মগোষ্ঠীর সব আদেশ নির্দেশ, আবদার অনুরোধ মেনে নেওয়া কারণ সংখ্যায় তারা বেশি? গণতন্ত্র তো তাকেও দেখভাল করে, যে সব ধর্মগোষ্ঠীর বাইরে, যে একা, যারা মতের সংগে কারও মতের মিল নেই। সে কারণে এই তন্ত্রের নাম গণতন্ত্র, তা না হলে এটা হতো ‘জোর যার মুল্লুক তার’, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের রাজ্য’, অথবা পাকিস্তানের মতো ‘ইসলামিক প্রজাতন্ত্র’। আমার মনে হয় বাংলাদেশের সময় হয়েছে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের বদলে দেশের নাম ইসলামিক প্রজাতন্ত্র রাখা।

যারা ইসলাম জপ করছে, তাদের দেখলে মনে হবে ইসলামের সবকিছু মেনে চলছে , আসলে কিন্তু ইসলামের অধিকাংশ আদেশই তারা মানছে না। তারা ঘুষ খাচ্ছে, মদ খাচ্ছে, মিথ্যে বলছে, ধর্ষণ করছে খুন করছে -- যত অনৈতিক কাজ আছে করছে। মাথায় হিজাব পরলেই বা টুপি পরলেই বা মুখে দাড়ি রাখলেই কেউ সাচ্চা মুসলমান হয়ে যায় না। সাচ্চা মুসলমান হতে গেলে ইসলামের বিধি নিষেধগুলো মানতে হবে। কজন মানতে পারবে সেসব?

কোরান সংগীত নিষিদ্ধের কথা বলেনি-- এই কথা বলেছেন বলে বাংলাদেশের বাউল শিল্পী শরিয়তকে জেল খাটতে হচ্ছে। তাহলে কোরান যদি নাচ গান বাজনা, প্রাণীর ছবি আঁকা নিষিদ্ধই করে, তাহলে নাচ গান বাজনা ছবি আঁকা ছবি তোলাও তো হারাম। হারাম কাজ করে মাথায় টুপি বা হিজাব পরেই কি সত্যিকার মুসলমান হওয়া সম্ভব? সত্যিকার মুসলমান না হয়েই মুসলমান হওয়ার গর্বে মাটিতে লোকের পা পড়ে না। নিরবধি বিচার করেই যাচ্ছে কে কতটা মুসলমান, কে কতটা নয়, কে কার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিল, কাকে ফাঁসি দিতে হবে! যারা ধার্মিক নয়, তাদের বিরুদ্ধে যখন একের পর এক হত্যা, জখম, নিষেধাজ্ঞা, হুমকি ইত্যাদি আসতে থাকে, আর সরকার মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে, তখন কোন অন্ধকারে গিয়ে লুকোয় আমাদের গণতন্ত্র?

নামেই শুধু গণতন্ত্র। কাজে নয়। এই রাষ্ট্রে শুধু এক পক্ষের অধিকার। অন্য পক্ষের মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে রাষ্ট্র দাঁড়ায় না, বরং তাদের জেলে পোরে। এই রাষ্ট্রকে সত্যিকার গণতন্ত্র হিসেবে মাথা উচুঁ করে দাঁড়াবার ব্যাপারে কেউ কি নেই পরামর্শ দেওয়ার? বিশ্বের বাজারে গণতন্ত্রের মূল্য ভালো, ধর্মতন্ত্র বা রাজতন্ত্রকে আজ না হোক কাল কিন্তু পাততারি গুটোতে হবে। (ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)