গণধর্ষণের ঘটনায় আত্মহত্যা

মৃত্যুর পরও অবিচারের শিকার পপি!

বোনের বাড়িতে গণধর্ষণের শিকার হয়ে অপমানে আত্মহত্যা করেন সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার অলংকারী ইউনিয়নের লালটেক গ্রামের শুকুর আলীর মেয়ে পপি বেগম (১৯)। আত্মহননের পর যথারীতি নিজের পারিবারিক কবরস্থানে দাফনের কথা থাকলেও গ্রাম্য মোড়ল ও স্থানীয় কুসংস্কারের কারণে নিজের জন্মভূমিতে দাফনের সুযোগ পায়নি পপি। ফলে সিলেট নগরীর মানিকপীর টিলায় তার লাশ দাফন করা হয়।

আত্মহননকারী দাফনের পর ভুত হয়ে স্থানীয়দের জ্বালাতন করবে এ বিশ্বাসে পপির লাশ স্থানীয়ভাবে দাফন করা সম্ভব হয়নি এমনটাই জানিয়েছে তার পরিবার।। পুরো গ্রামবাসী এ ব্যাপারে অবগত ঠিকই কিন্তু মুখ খুলতে সম্পূর্ণ নারাজ। এমনকি নিহত পপির পরিবারও।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আজ থেকে ২০ বছর আগে লালটেক গ্রামের জনৈক জয়বান বিবি (৭০) এর ছেলে ঠিক অনুরূপভাবে আত্মহত্যা করলে তার লাশও ওই গ্রামে দাফন না করে সিলেটের মানিকপীর টিলায় দাফন করা হয়।

আত্মহননকারী পপির ছোট বোন রিপা সাংবাদিকদের জানান, আত্মহত্যার পর ময়নাতদন্তের মাধ্যমে আমার বোনের লাশ পরিবারের লোকজন মানিক পীর টিলায় দাফন করেন। গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে পপির লাশ কেন দাফন করা হয়নি এ প্রশ্নের জবাবে রিপা হিমশিম খায়। তবে সে জানায়, দাফনের পর আত্মহননকারী ভুত হয়ে স্থানীয়দের জ্বালাতন করবে এমন ভয়ে গ্রামে তার লাশ দাফন করা হয়নি। এ ব্যাপারে স্থানীয় মুরুব্বিয়ানদের ভূমিকা নিয়ে রিপা কোনো উত্তর দেয়নি।

অন্যদিকে, পপির বড় ভাই মনোয়ার হোসেন জানান, দাফন কাপনের টাকা না থাকায় পারিবারিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই তার বোনকে সিলেটের মানিকপীর টিলায় দাফন করা হয়।

স্থানীয় ইউপি সদস্য আলতাব আলী বলেন, লোকমুখে পপির আত্মহত্যার খবর পেয়েছি। তবে গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে কেন পপির লাশ দাফন করা সম্ভব হয়নি এ ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। বিস্তারিত স্থানীয় মুরব্বীয়ানরা অবগত রয়েছেন বলে তিনি জানান।

এ ব্যাপারে বিশ্বনাথ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বর্ণালী পাল সাংবাদিকদের বলেন, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। বিষয়টি আজকে আমি শুনেছি। তবে নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে আমাদেরকে এখনো জানানো হয়নি। যদি দাফনের পূর্বে জানানো হতো তাহলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা যেত। তবুও থানার অফিসার ইনচার্জকে আমি বলেছি, ওই পরিবারকে সার্বিক সহযোগিতা করার জন্য।

উল্লেখ্য, পপি বেগম (১৯) গত ৯ অক্টোবর দিবাগত রাতে তার বোনের বাড়ি তেতলী চেরাগী গ্রামে গণধর্ষণের শিকার হয়। পরদিন সকালে সে বোনের বাড়ি থেকে নিজ বাড়িতে ফিরে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে। তাকে দাফনের দুই দিন পর তার ব্যবহৃত ভ্যানেটি ব্যাগে নিজ হাতে লেখা একটি চিরকুট (সুইসাইড নোট) পায় পরিবার। ওই চিরকুটে পপি উল্লেখ করেন, ৯ অক্টোবর দিবাগত রাতে বোনের বাড়িতে অবস্থানকালে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে সে ঘরের বাহিরে যায়। তখন পূর্ব থেকে ওঁৎ পেতে থাকা বারিক ও জাহেদ তার (পপির) মুখ চেপে ধরে তাকে জোরপূর্বক উঠিয়ে নিয়ে যায় বাড়ির পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে। তখন তাদের পায়ে ধরে কান্নাকাটি করতে থাকলে বারিক-জাহেদ ও তাদের সহযোগীরা মারধর করে পপিকে পাশবিক নির্যাতন করে। নির্যাতনের পর পপিকে বোনের বাড়িতে (যেখান থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয়, সেই স্থানে) ফেলে রেখে যায় জাহাঙ্গীর। আর গণধর্ষণের লজ্জা সইতে না পেরে সে আত্মহত্যা করে।

এ ঘটনায় ৪ জনকে আসামি করে গত সোমবার রাতে বিশ্বনাথ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন নিহতের পিতা শুকুর আলী। মামলা দায়েরের পর ওই রাতেই নিহতের ভগ্নিপতি ও তেতলী চেরাগী গ্রামের মৃত আবদুল মন্নানের ছেলে ফয়জুল ইসলাকে গ্রেপ্তার করে থানা পুলিশ। পরদিন মঙ্গলবার রাতে মামলার অপর আসামি একই গ্রামের মৃত মতছির আলীর ছেলে জাহেদকে (২২) এবং বৃহস্পতিবার রাতে মামলার প্রধান আসামি জাহাঙ্গীর আলম (৩৫)’কে গ্রেপ্তার করে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-৯)। তবে মামলার অপর আসামি তেতলী চেরাগী গ্রামের আবদুল মনাফের ছেলে বারিক মিয়া (৩৭) এখনো পলাতক রয়েছে।


সর্বশেষ সংবাদ