‘বঞ্চনা ও হতাশা’ থেকেই সাধারণ ক্যাডারে চিকিৎসক-ইঞ্জিনিয়াররা!

  © প্রতীকী ছবি

দীর্ঘ প্রায় তিন বছর ধরে প্রিলিমিনারি, লিখিত ও ভাইভা পরীক্ষা শেষে সম্প্রতি ৩৮তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করেছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। গত ৩০ জুন প্রকাশিত ফলে দুই হাজার ২০৪ জনকে ক্যাডার পদে সুপারিশ করা হয়েছে। তবে সর্বশেষ প্রকাশিত এই বিসিএসের ফলাফল এবার ভিন্ন কারণে ছিল ব্যাপক আলোচিত।

জানা গেছে, অতীতে বিবিএসে ক্যাডার হওয়ার দৌড়ে সাধারণত বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিকের বিষয়গুলোর শিক্ষার্থীদের দৌরাত্ম্য ছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এসে মেডিকেল কিংবা প্রকৌশলের (ইঞ্জিনিয়ারিং) শিক্ষার্থীরাও বেশ ভালোভাবে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছেন। বিশেষত মেডিকেল শিক্ষার্থীরা চিকিৎসা পেশা ছেড়ে প্রশাসন ক্যাডারে আগ্রহী হয়ে ওঠায় তা বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

অবশ্য এর নেপথ্যে বেশ ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থীরা। কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এমবিবিএস কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করলেও কাঙ্ক্ষিত মানের চাকরি পাচ্ছেন না তারা। ফলে বিসিএস ক্যাডার হওয়া তাদের জন্য একটি ভালো সুযোগ হিসেবে তারা মনে করছেন। এমনকি এমবিবিএস ডিগ্রি অনেক কষ্ট করে পাস করলেও কিছুক্ষেত্রে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে নামমাত্র বেতনে চাকরি হচ্ছে। ফলে তাদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বাড়ছে।

এছাড়া যারা বিবিএসের স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগ দিচ্ছেন, তারা নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন বলেও মনে করছেন। ৩৭তম বিসিএসে নিয়োগ পাওয়া একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘৩৩তম বিসিএসে যারা নিয়োগ পেয়েছিলেন, তাদের অনেকে এখন ইউএনও পর্যন্ত হয়ে গেছেন। বাড়ি, গাড়ি, গান ম্যান, প্রমোশনসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা তারা পেয়েছেন। কিন্তু সে তুলনায় ওই বিসিএসে নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসকরা এখনও কিছুই পাননি।’

তিনি বলেন, ‘চিকিৎসকদের একটি পদোন্নতি পেতে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়। এমডি, এফসিপিএস ডিগ্রি থাকলেও অনেক সময় তা কোনো কাজে আসে না। এজন্য ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এবং বঞ্চনা ও হতাশা থেকে মুক্তি পেতে প্রশাসন-পররাষ্ট্র-পুলিশ ক্যাডারের দিকে চিকিৎসকদের আগ্রহ বাড়ছে।’

এ অবস্থার অবসানে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য কমিয়ে নিয়ে আসার ওপর জোর দিচ্ছেন শিক্ষাবিদরা। ৩৮তম বিসিএসের প্রকাশিত ফলাফল অনুযায়ী, সাধারণ ক্যাডারে ৬১৩ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে পররাষ্ট্রে ২৫ জন, পুলিশে ১০০ জন, প্রশাসনে ৩০৬ জন,  আনসারে ৩৮ জন রয়েছে। এ ক্যাডারগুলোয় অতীতের তুলনায় চিকিৎসক ও ইঞ্জিনিয়ারদের সংখ্যা বেশি দেখা গেছে। বিশেষ করে পররাষ্ট্র ক্যাডারের সিংহভাগই তাদের দখলে। যদিও এর সুনির্দিষ্ট সংখ্যা জানা যায়নি। ৩৮তম বিসিএসে সহকারী সার্জন হিসেবে ২২০ জন এবং ডেন্টাল সার্জনে ৭১ জনও নিয়োগের সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানে অধ্যয়নরত কয়েকজন শিক্ষার্থীরা সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একসময় বুয়েট কিংবা ঢাকা মেডিকেলের মতো প্রতিষ্ঠানের হলগুলোয় বিসিএসের বই পড়তে হতো লুকিয়ে। কারণ এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের চাকরি ছিল অনেকটা নিশ্চিত। অনেকে বিদেশে চলে যেতেন মোটা বেতনের চাকরি পেয়ে কিংবা উচ্চতর ডিগ্রি নিতে। কিন্তু এখন এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের হলগুলোয় বিসিএসের প্রস্তুতি নেওয়া হয় প্রকাশ্যেই।

সম্প্রতি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শহীদ ডা. ফজলে রাব্বি হলে সরেজমিন গিয়ে তার সত্যতাও মেলে। সেখানে দেখা যায়, মেডিকেলের বইয়ের পাশাপাশি বিসিএসের বইও টেবিলে থরে থরে সাজানো। অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানের ছাত্রদের আগে থেকেই বিসিএসে আগ্রহী থাকতে দেখা গেছে। এখন তাদের সঙ্গে বুয়েটের মতো প্রকৌশল ও ঢাকা মেডিকেলের শিক্ষার্থীরাও বিসিএসে আগ্রহী হয়ে উঠছেন বলে জানা গেছে।

বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেলে দ্বিতীয়বর্ষে অধ্যয়নরত এক ছাত্র বলেন, ‘আমি মেডিকেলে ভর্তি হয়েছিলাম চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই। কিন্তু তা আর এখন নেই। কারণ এমবিবিএস পাস করে চাকরি পাবো কিনা ঠিক নেই, রয়েছে চরম অনিশ্চয়তা। এ কারণে এখন থেকেই বিসিএস সাধারণ ক্যাডারের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছি।’

এ ধরনের সমস্যার সমাধান কীভাবে হতে পারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘অন্যান্য ক্যাডারের সঙ্গে প্রশাসন ও পুলিশ ক্যডারের বৈষম্য প্রকট হয়ে উঠেছে। ফলে শিক্ষা কিংবা বিশেষায়িত ক্যাডারগুলোয় ক্ষোভ বাড়ছে। একই পদ্ধতিতে নিয়োগ পেয়ে অন্যরা যখন বাড়তি সুবিধা পাবে তা ক্ষোভ সৃষ্টি করবে, এটাই স্বাভাবিক। এজন্য বৈষম্য খুব দ্রুত দূর করতে হবে। অন্যথায় ভবিষ্যতে এর পরিণতি ভালো নাও হতে পারে।’

৩৮তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় পাস করেন ৯ হাজার ৮৬২ জন। পরীক্ষায় অংশ নেন ১৪ হাজার ৫৪৬ জন। লিখিত পরীক্ষায় পাস করা প্রার্থীরা মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেন। গত ফেব্রুয়ারিতে মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয়। ৩৮তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা শেষ হয় ২০১৯ সালের ১৩ আগস্ট। ২০১৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর ৩৮তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়।

পরীক্ষা হওয়ার প্রায় দুই মাসের মধ্যে এর ফলাফল প্রকাশ করা হয়। প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অংশ নিতে তিন লাখ ৮৯ হাজার ৪৬৮ জন প্রার্থী আবেদন করেছিলেন। পিএসসি সূত্র জানায়, ৩৮তম বিসিএসের মাধ্যমে জনপ্রশাসনে দুই হাজার ২৪ জন ক্যাডার কর্মকর্তা নিয়োগ করার কথা ছিল। পরে ১৩৬ জন বেশি নিয়োগের প্রস্তাব আসে জনপ্রশাসন থেকে। এতে এই বিসিএসে মোট পদের সংখ্যা হয় দুই হাজার ১৬০।

পরে ২৪০ জন যুক্ত হয়ে মোট পদের সংখ্যা হয় ২ হাজার ৪০০। যদিও শেষ পর্যন্ত দুই হাজার ২০৪ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। এর আগে ৩৯তম বিশেষ বিসিএস থেকে দু‘দফায় প্রায় সাত হাজার জনকে চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার।


সর্বশেষ সংবাদ