সরকারি চাকরিতেই কেন ঝোঁক তরুণদের?

  © টিডিসি ফটো

দেশের সরকারি চাকরির প্রতি তরুণদের আগ্রহ সবসময়ই ছিল। তবে, গত কয়েক বছর আগেও তাদের মধ্যে এতটা আগ্রহ দেখা যায়নি। বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ার পর থেকেই সরকারি চাকরিতেই ঝুঁকেছে তরুণদের বিরাট অংশ। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় গত বছর আবেদনকারীর সংখ্যা রেকর্ড গড়েছে।

অন্য দিকে, বেসরকারি খাতে ভালো সুযোগ থাকলেও কেবল সরকারি চাকরির আশায় বছরের পর বছর নষ্ট করছেন তারা। তবে নিজের বহুমুখী দক্ষতার মাধ্যমে সরকারি চাকরি নির্ভরশীলতা কমানো সম্ভব বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনেরা।

খোঁ নিয়ে জানা গেছে, অনেক শিক্ষার্থী পাশ করার পর ৪-৫ বছরও কাটিয়ে দিচ্ছেন প্রথম শ্রেণীর সরকারি চাকরির জন্য। অন্যদিকে অনেকে বেসরকারি চাকরি করার পরেও তা ছেড়ে দিয়ে সরকারি চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন।

গত আগস্টে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে চালানো এক যুব-জরিপে দেখা গেছে, শিক্ষিত যুবদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ নারী এবং ৪২ শতাংশ পুরুষ সরকারি চাকরি করতে চান। এসব চাকরিতে পদ যতগুলো, আবেদনকারী ২০০ গুণের বেশি।

এদিকে বিসিএস পরীক্ষাটি প্রথম শ্রেণির গেজেটভুক্ত কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য। অন্য ক্ষেত্রগুলোয় পদপ্রতি সাড়ে আট হাজারের বেশি আবেদনকারীর নজির আছে। চাকরির পরীক্ষা ঝুলে যাচ্ছে অনেকের, আবার তাতে পাস করেও নানা কারণে চাকরি হচ্ছে না তাদের। তবুও দেশে তরুণদের ঝোঁক সরকারি চাকরিতেই।

এসব চাকরি পেতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাগে। আর দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৪ লাখ। বেসরকারি খাতের চাকরিতেও কিন্তু প্রতিযোগিতা তীব্র। তবে চাকরিদাতারা বলছেন, অত পদ সেখানে নেই। তা ছাড়া চাকরিপ্রত্যাশীর যোগ্যতার সঙ্গে ব্যাটেবলে মেলে কম।

এ বিষয়ে বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন জরিপটির ফলাফল তুরে বলেন, তরুণদের বড় অংশ বয়সসীমা না পেরোনো পর্যন্ত সরকারি চাকরির চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হলে তবেই তাঁরা বেসরকারি চাকরি খোঁজেন। অন্যদিকে, দক্ষ ও শিক্ষিত চাকরিপ্রার্থীদের বড় অংশ সরকারি চাকরিতে চলে যাওয়ায় বেসরকারি চাকরির চাহিদামতো ছেলেমেয়েদের জোগান থাকছে না।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার জানান, ২০১৫ সালে সরকারি বেতনকাঠামো পুনর্গঠনের পর প্রতিটি গ্রেডে বেতন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা আর অবসর ভাতাও অনেক বেড়েছে। চাকরির নিরাপত্তা তো আছেই। উল্টো দিকে কথিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সমান তালে বেসরকারি খাতে কাজের সুযোগ তৈরি হয়নি। বাড়তে থাকা শিক্ষিত তরুণদের জন্য সেখানে যথেষ্ট চাকরি নেই।

মাত্রাতিরিক্ত আবেদন ও পরীক্ষার জট:
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ১২ ধরনের ২৪২টি পদে কর্মকর্তা ও সদস্য নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়। গড়ে পদপ্রতি প্রায় ৯০০ আবেদন জমা পড়ে। প্রাথমিক যাচাই করাও দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। এগুলোর মধ্যে উপপরিদর্শকের (এসআই) নয়টি পদ ছিল। সেখানে পদপিছু গড়ে সাড়ে আট হাজারের বেশি তরুণ আবেদন করেন। এসআই পদে সব মিলিয়ে বেতন প্রায় ২৬ হাজার টাকা।

গত বছর খাদ্য অধিদপ্তর ১ হাজার ১০০ পদে লোক নিতে বিজ্ঞপ্তি দিলে পদপ্রতি ১ হাজার ৪০০টির কাছাকাছি আবেদন জমা পড়ে। পদ ছিল ২৪ ধরনের। সবচেয়ে বেশি আবেদন আসে সহকারী খাদ্য পরিদর্শক (এএফআই) পদের জন্য। প্রতিটি পদে গড়ে এসেছিল প্রায় আড়াই হাজার আবেদন। আর প্রতিটি খাদ্য পরিদর্শক পদের জন্য গড় আবেদনকারী ছিলেন দেড় হাজারের বেশি। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন প্রশাসনিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা কয়েক দফা পরীক্ষা নিতে চেষ্টা করে পারেননি। বিষয়টি ঝুলে আছে।

চলতি বছর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১১ হাজার শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। আবেদন জমা পড়ে ২৬ লাখ। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর হিমশিম খেয়ে পাঁচবার পরীক্ষা পেছায়। তারপর চার দফায় আলাদা তারিখে পরীক্ষা নেয়। শেষ দলটির পরীক্ষা হয় গত জুনে। পদপ্রতি পাঁচজনের মতো পরীক্ষায় পাস করেছেন।

গত সেপ্টেম্বরে বিপিএসসি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগের জন্য পরীক্ষা নিয়েছে। পদ ছিল প্রায় ২ হাজার। পদপ্রতি আবেদনকারীর সংখ্যা ১১৮।

২০১৮ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন ব্যাংকে মোট ৭ হাজারের বেশি কর্মকর্তা নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। আবেদন করেন প্রায় ১১ লাখ প্রার্থী, পদপ্রতি গড়ে ১৪৭ জন। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে নিয়োগসংক্রান্ত কর্তৃপক্ষ ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি (বিএসসি) বলছে, ব্যাংকে নিয়োগের ক্ষেত্রে এর আগে একসঙ্গে এত প্রার্থী আবেদন করেননি।

কমিটির সাবেক প্রধান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক মোশাররফ হোসেন খান জানান, সমন্বিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির কারণে আবেদন বেড়েছে। এখন আর আবেদন করার জন্য ফি দিতে হয় না, সেটা বাড়তি আকর্ষণ।

আর সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রদীপ কুমার দত্ত বলছেন, বেশি বেতন, চাকরির নিশ্চয়তা, নানা ধরনের ঋণসুবিধা থাকায় ব্যাংকের চাকরি লোভনীয়। তবে আবেদন বাড়ার আরেকটি কারণ বেকারত্ব।

সবখানেই শিক্ষিত বেকারের চাপ:
দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী অর্থাৎ শ্রমশক্তির বয়স শুরু হয় ১৫ বছর থেকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ বলছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তাদের মধ্যে স্বীকৃত সংজ্ঞা অনুযায়ী বেকার ছিল প্রায় ২৭ লাখ। এই বেকারদের প্রায় ৯০ ভাগই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রাপ্ত, বাকিরা শিক্ষাবঞ্চিত। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ডিগ্রিধারী আছেন চার লাখের বেশি (১৫ শতাংশ)। শিক্ষিত বেকারদের সবচেয়ে বড় অংশটি মাধ্যমিক পাস (এসএসসি)। তারপরই আছেন উচ্চমাধ্যমিক পাস (এইচএসসি) ব্যক্তিরা। শেষের দুই দল সম্মিলিতভাবে বেকারদের প্রায় ৬০ ভাগ।

এই বেকারেরা শ্রমশক্তির ৪ দশমিক ২ শতাংশ। অর্থাৎ এটাই বেকারত্বের জাতীয় গড় হার। মোট বেকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা সামান্য বেশি। এইচএসসি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী বেকারদের মধ্যে আবার পুরুষের সংখ্যা বেশি। এই দুই দলের মধ্যে বেকারত্বের হার জাতীয় হারের চেয়ে অনেক বেশি। সেটা ২০১৫-১৬ সালের তুলনায় বেড়েও গেছে।

কর্মসংস্থান বিষয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সর্বশেষ বৈশ্বিক প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছর বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ৩০ লাখে উঠতে পারে। বেকারত্বের হারও কমবে না। বেকারত্বের হারের বিচারে দক্ষিণ এশিয়ার আট দেশের মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয়।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় ভালো ফল করা আর উচ্চশিক্ষিত তরুণদের চাকরির দুর্দশার কথা উঠে এসেছে। অনলাইনে এসএসসি, এইচএসসি, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ১৫ হাজারের মতো উত্তরদাতার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জরিপটি করা হয়েছে। তাঁদের এক-তৃতীয়াংশই নিজেদের বেকার বলেছেন। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকার বেশি। খুব ভালো ফল করেও তাঁদের কমবেশি এক-তৃতীয়াংশ কর্মহীন বসে আছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জেলা প্রশাসক (ডিসি) জানিয়েছেন, সরকারি চাকরির যেসব পদে শিক্ষাগত যোগ্যতার চাহিদা অষ্টম শ্রেণি পাস, সেগুলোতে এখন এসএসসি বা এইচএসসি পাস ব্যক্তিরা আবেদন করছেন। আবার এসএসসি বা এইচএসসি পাস চাওয়া হলে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাস ছেলেমেয়েরা আবেদন করছেন। মৌখিক পরীক্ষায় তাঁরা নিচু পদে আবেদনের কারণ হিসেবে সরকারি চাকরির নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদার কথা বলেন।

উত্তরণ কোন পথে?
সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলছেন, সরকারি চাকরিতে এত ঝোঁক মোটেই ইতিবাচক নয়। বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান না হলে শিক্ষিত বেকারত্বের মোকাবিলা করা যাবে না। পরিণতিতে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন আর সামাজিক শৃঙ্খলা পদে পদে ঠেকে যাবে। তিনি উদ্যোক্তা তৈরির জন্য সরকারি সহযোগিতা বাড়ানোর ওপরেও জোর দিলেন।

বিপিএসসির সদস্যসহ সাবেক কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগকর্তা ও মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞ বলছেন, বেসরকারি খাতে চাকরি যে একেবারে নেই তা নয়। তবে পদ সীমিত এবং দক্ষতার চাহিদাও বেশি।

বিডি জবস ডট কম সুপরিচিত একটি চাকরির পোর্টাল। ফাহিম মাশরুর প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী। কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কার্যক্রম পর্যালোচনা করে তিনি বলছেন, সেখানেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র। ১৫ থেকে ২০টি পদের জন্য এক-দেড় লাখ সিভিও জমা পড়তে দেখা যায়।

ফাহিম জানান, এসব চাকরিপ্রার্থীর একটি বড় অংশের দক্ষতার ঘাটতি থাকে। হয়তো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো ফল নিয়ে বেরিয়েছে। কিন্তু চাকরির লিখিত পরীক্ষায় ভালো ইংরেজি বা বাংলায় কিছু লিখতে পারছে না। এ কথারই প্রতিধ্বনি করলেন এসিআই লিমিটেডের মানবসম্পদ বিভাগের পরিচালক মঈনুল ইসলাম। তিনি বললেন, বিজ্ঞাপন দিলে আবেদন প্রচুর জমা পড়ছে। কিন্তু চাহিদামতো দক্ষ তরুণ পাচ্ছেন না।

চাকরিদাতা ও বিশেষজ্ঞ-নির্বিশেষে সবাই বেসরকারি কর্মসংস্থানের ওপর যেমন জোর দিচ্ছেন, তেমনি তাঁরা চাকরিপ্রার্থীদের শিক্ষা ও দক্ষতার বিকাশকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন।

যিশু তরফদার মানবসম্পদ উন্নয়নবিষয়ক প্রতিষ্ঠান করপোরেট কোচের মুখ্য পরামর্শক। তিনি জানান, তরুণদের নিজেদের উদ্যমী হতে হবে। পড়াশোনার পাশাপাশি তরুণেরা কম্পিউটারের বিভিন্ন দক্ষতা, ভিডিও এডিটিং, ফটোগ্রাফিসহ নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। তা হলে বেসরকারি চাকরি তো বটেই, সরকারি চাকরির জন্যও তিনি চৌকস হয়ে উঠবেন। [সূত্র: প্রথম আলো]


সর্বশেষ সংবাদ