সরকারি চাকরি খুঁজতে গিয়ে ‘মানসিক বন্ধ্যাত্ব’ বাড়ছে!

  © টিডিসি ফটো

ঈদের আমেজে বন্ধুরা সবাই বাড়ি যাওয়ার টিকেট কাটলেও সুজন (ছদ্মনাম) এবার নিয়ে ৩ বছর ঈদে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয় হলেই সাদামাটাভাবে কেটে যায় দিনটি। মায়ের কান্না, ভাই-বোনের হাজার অনুরোধ আর বাবার বকুনি—কিছুই তাকে বাড়িমুখী করতে পারেনি। নিজেকে এভাবে দূরে সরিয়ে দেয়ার কারণ কি আসলে? বাড়ির পাশের এক কাছের বন্ধুর কাছে সব খুলে বলে সুজন।

মাস্টার্স পাশ করে বের হয়েছে ৫ বছর হতে চললো। কিন্তু এখনো একটি সরকারী চাকরি জোটাতে পারেনি। বন্ধুদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সরকারী ব্যাংকের ১ম শ্রেণীর চাকরি করছ। বেকারত্বের অসহায়ত্ব, সমাজের কটূক্তি আর নিজেকে পরিবারের সবার কাছে বোঝা মনে হয়। তাই ফার্স্ট ক্লাস সরকারী চাকরি না পেলে বাড়ি যাবেনা বলে পণ করেছে।

উপরের ঘটনার চরিত্র সুজন একা নয় বরং লাখো উচ্চ শিক্ষিত বেকার যুবককে প্রতিনিধিত্ব করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে পাশ করে বের হওয়া ছাত্রছাত্রীদের বেকারত্বের পেছনে অনেকে ধরণের ব্যাখ্যা উঠে আসলেও চাকরির ব্যপারে তাদের মানসিকতার কথাটি খুব একটা উঠে আসেনা। সেটা আবার কি? তা হলো সুজনরা চাকরি আর ক্যারিয়ার বলতে বোঝেন, ফার্স্ট ক্লাস সরকারি চাকরি অথবা যে কোন একটি সরকারী চাকরি। প্রতিটি বিসিএস পরীক্ষার সময় আবেদনকারীর হার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বুয়েট, আইবিএ, মেডিক্যাল থেকে পাশ করা ছাত্র-ছাত্রীদের সরকারি জবে যোগ দেয়ার একটি বড় প্রমাণ।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রদের আত্মহত্যার ঘটনা খতিয়ে দেখা যায়, বেশীরভাগের পেছনে মূল কারণ ছিল একটি ভাল চাকরি (!) জোটাতে পারেনি। তাই গ্লানি নিয়ে নিজেকে শেষ করে শান্তি খুজেছে। ভাল চাকরির সংজ্ঞা খুজে একই জিনিস মিলে, তা হলো সরকারী ভালো চাকরি (ফার্স্ট/সেকেন্ড ক্লাস/সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক)। অথচ এদের সবারই অন্য যে কোন সেক্টরে ক্যারিয়ার গড়ে সেরাদের সেরা হওয়ার সুযোগ ছিল। পারতো দেশ সেরা উদ্যোক্তা হতে অথবা প্রাইভেট সেক্টরে খ্যাতিমান কোন কোম্পানীর সিইও হতে অথবা দেশ সেরা রিসার্চার হতে।  কিন্তু বদ্ধ ও ছকে বাঁধা মাইন্ডসেট তাদের ভিন্ন চিন্তার সুযোগটুকুও দেয়নি।

এবার আসি দেশের চাকরির বাজার বিবেচনায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘লেবার ফোর্স সার্ভে ২০১৬-২০১৭’ অনুযায়ী বাংলাদেশের তরুণদের কর্মসংস্থানের চাহিদার মাত্র ৩.৮% মেটাতে পারে সরকারি এবং আধা-সরকারি চাকরি-সেটি ১ম শ্রেণী থেকে ৪থ শ্রেণী পর্যন্ত। আর বাকি ৯৬.২% কর্মসংস্থান আসে প্রাইভেট চাকরি (১৪.২%), নিজের উদ্যোগ (৬০%), কৃষি এবং অন্যান্য ছোট-খাটো পেশা থেকে। মোট চাকরির মাত্র ৩-৪% যোগান দেয় সরকারি খাত থেকে। বাকী ৯৫ ভাগের বেশি লোকবল লাগে প্রাইভেট সেক্টরে। কিন্তু শতকরা ৯০ ভাগ চাকরি প্রার্থীদের টার্গেট যদি থাকে ৫% চাকরিতে যে কোন মূল্যে যোগ দেয়া, তাহলে পরিস্থিতি কি দাঁড়ায় তা বুঝতে গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।

প্রশ্ন আসে তাহলে সব ধরণের ডিসিপ্লিন থেকে পাশ করে বের হওয়া ছাত্রছাত্রীদের এমন ইদুর-দৌড় দেয়ার প্রয়োজন পড়লো কেন? ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার যাচ্ছেন প্রশাসন আর ফরেন ক্যাডারে, কেমিস্ট করছেন ব্যাংকের ২য় শ্রেণীর চাকরি আর ফার্মাসিস্ট হয়ে যাচ্ছেন কোন মন্ত্রণালয়ের কম্পিউটার অপারেটর। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এটিই বাস্তবতা। এমন গণহারে সরকারি চাকরির পেছনে ছুটার পেছনে সব চেয়ে বড় কারণ হিসেবে দেখা যায় জব সিকিউরিটিকে।

সরকারি চাকরি একবার পেলে আর সারাজীবন চিন্তা করার দরকার পড়ে না। রিটায়ার্ড করলে পেনশন ও বিভিন্ন ভাতা পাবে, এটি বিশাল ইন্সেন্টিভ ইন্সিকিউরড বাঙ্গালীর জন্য। আরেকটি বড় কারণ হলো সামাজিক সম্মান। বিসিএস ক্যাডারদের ‘দেশের রাজা’ বানিয়ে ভার্সিটি ক্যাম্পাসে সংবর্ধনা দিতে দেখেছি। এমনকি মেয়ের বাবারা একজন সরকারি চাকরিজীবীর কাছে মেয়েকে তুলে দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। প্রাইভেট সেক্টরে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত মানুষদের টিটকারি শুনতে হয় যে তিনি ক্যাডার হননি। পাওয়ার স্ট্রাকচারের একটা ব্যপার তো থেকেই যায়। সব মিলিয়ে এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে যেন এটিই এখন সবার একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান হওয়া উচিত। আসলে কি তাই?

যায়েদ উদ্দিন

দেশসেরা মেধাবীদের ক্যারিয়ার নিয়ে এমন আবদ্ধ মানসিকতার ক্ষতিগুলোতে একটু নজর বুলানো যাক। প্রথমটি হলো বছরের পর বছর ৯০℅ মানুষের ৫% চাকরির পেছনে দৌঁড়াতে গিয়ে অন্য যে কোন চাকরি করার সামর্থ থাকার পরও স্বেচ্ছায় বেকার থাকা যেটি দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে বাধ্য। এমনও অনেককে দেখেছি, যারা ৪-৫ বছর ধরে বিসিএস প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ২ বার লিখিত পরীক্ষায় ফেইল করেছেন কিন্তু চাকরি হয়নি বলে বয়স ৩০ হওয়া পর্যন্ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন সম্পূর্ণ বেকার থেকে। শেষে কোন ধরণের চাকরি না হলে বাধ্য হয়ে অন্য কোন চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন। এ ৫ বছর একটি চাকরির প্রস্তুতির পেছনে ব্যয় করাটাকে কোন যুক্তিতে আমরা বৈধতা দিচ্ছি? অন্য আরেকটি ক্ষতি হল প্রাইভেট সেক্টরে মেধাবীদের আনাগোনা কমে যাওয়া। বিশাল গার্মেন্টস ইন্ড্রাস্ট্রি থেকে শুরু করে অন্যান্য উঠতি সেক্টরগুলোর উদোক্তাদের ভালো পজিশনগুলোতে বিদেশী নিয়োগ দিতে হয়; কারণ দেশে এক্সপার্ট নেই। থাকবেই বা কেমনে! যেখানে MP3-এর বইয়ে মুখ গুজে দেশ, মুদ্রা, রাজধানীর নাম মুখস্ত করে মেধাবীরা, সেখানে অন্য কোন স্পেলাইজড স্কিল নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে, সময় বা সুযোগই কোথায়? একইভাবে, শিক্ষত বেকারদের মাঝে বাড়ছে হতাশা, যার সামাজিক ক্ষতির দিকগুলো কারো অজানা নয়। আমার সবচেয়ে বড় ভয় হলো-মাইন্ডসেট নিয়ে। এ অদ্ভুত মাইন্ডসেট দেশকে বিভিন্ন দিক থেকে পিছিয়ে দিতে বাধ্য।

তাহলে কি করা দরকার আসলে? যদি কেউ সরকারি চাকরি পছন্দ করে আর সেটার জন্য সময় দিয়ে প্রস্তুতি নিতে চায়, তাহলে আপত্তি করার কিছু নেই। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে সে অপশন বি রাখছে কিনা আর কত সময় নিচ্ছে জব পেতে। তারপর দরকার ওদের মাইন্ডসেট নিয়ে কাজ করা। সরকারি চাকরির এতটা ক্রেজ গত ৫ বছর আগেও ছিল না। সরকার কতৃক চাকরিতে বেতন ও সুবিধা বৃদ্ধি যেমন একটি কারণ তেমনি কিছু ভালো রেজাল্টধারী বিসিএস ক্যাডারদের একচেটিয়ে গাল-গপ্পো ও মোটিভেশান অনেককেই চরমভাবে উৎসাহিত করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় হল থেকে শুরু করে লাইব্রেরিতে গেলেই এ ক্রেজের ফিল পাওয়া যায়। তাই দরকার কাউন্সেলিং। যারা এ একটা অপশন ছাড়া অন্য কিছু ক্যারিয়ারের জন্য ভাবতেই পারছে না, তাদের বোঝানোর ব্যবস্থা করা উচিত। সরকারি ও বেসরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়ে এটি বাস্তবায়নে নেমে যাওয়া দরকার। শুনতে একটু উদ্ভট শুনালেও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের কথা ভেবে আমাদের মেধাগুলোকে ডাইভার্সিফাইড করা সময়ের দাবী।

পাশাপাশি উদ্যোক্তা তৈরিতে পরিকল্পিত ব্যবস্থা, প্রাইভেট সেক্টরে বিনিয়োগ ও চাকরির সুযোগ সৃষ্টি, সরকারি চাকরিতে প্রণোদনার ব্যালেন্স ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কর্মমুখী শিক্ষার বাস্তবায়ন দ্রুতই করতে হবে। আর না হলে এ ইদুর দৌঁড়ে হারিয়ে যাবে মেধাবীরা, তাকে দিয়ে অনেক কিছু করে ফেলা যে সম্ভব সেটি না বুঝেই অকালে শেষ করে দিবে নিজেকে। যা করতে পারতো, তার চেয়ে অনেক কম অবদান রেখে সুখী হওয়ার ভাব করবে, আর আমাদের দেশকে তার জিডিপির বিশাল একটি অর্থ বিদেশী এক্সপার্টদের পেছনেই ঢালতে হবে। শুভ বুদ্ধির উদয় হউক।  

লেখক: এসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম অফিসার, দি এশিয়া ফাউন্ডেশন                                                


সর্বশেষ সংবাদ