করোনা: এক ভুল বার্তায় সর্বনাশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের!

  © ডয়েচে ভেলে

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা হঠাৎ কমে যাওয়ার থেকে মিষ্টির দোকান খোলার সিদ্ধান্ত, অথবা পুলিশের গান গেয়ে ভুল বার্তা— অতি উৎসাহই কি কাল হবে?‌ সে প্রশ্ন উঠছে। জনপ্রিয় বাংলা সিনেমায় কিশোরকুমারের গলায় বিখ্যাত গান, ‘আজ এই দিনটাকে মনের খাতায় লিখে রাখো’।

এই গানেরই কথা সামান্য অদলবদল করে নেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় লাইন ‘আমায় পড়বে মনে, কাছে, দূরে যেখানেই থাকো’ বদলে নিয়ে করা হয়েছে ‘দিনটা পড়বে মনে, করোনার পর যদি বেঁচে থাকো’! পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার রামপুরহাটের এসডিপিও স্বয়ং এই গান গেয়ে শুনিয়েছেন রেশন দোকানের বাইরে বিনা পয়সার সরকারি চাল, ডাল নেওয়ার অপেক্ষায় থাকা মানুষজনের উদ্দেশে।

চৈত্র মাসের কড়া রোদে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর মুখের অবস্থা দেখার মতো হয়েছিল, ওই ‘করোনার পর যদি বেঁচে থাকো’ শুনে। ভিডিওটি সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়েছে ফোনে ফোনে। যেমন কলকাতার এন্টালি থানার ওসি একটি আবাসনের সামনে সাউন্ড বক্স বাজিয়ে ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ ইংরেজি, বাংলা এবং হিন্দি, তিন ভাষায় গেয়ে শুনিয়েছেন।

লোকে ভিড় করে দেখেছে, মোবাইলে ভিডিও তুলেছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিধানের দফারফা হয়েছে। প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, পুলিশের এই অতি উৎসাহ কি বিপদ ডেকে আনবে? পুলিশের উদ্দেশ্য যে মহৎ, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু জনপ্রিয় গানে নিজেদের মতো কথা বসিয়ে কি ঠিক বার্তা দেওয়া হচ্ছে?

দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়াহাট থানা এলাকায়, একটি অভিজাত আবাসনের সামনে শিল্পী অঞ্জন দত্ত–র ‘২৪৪১১৩৯’ গানটির সুরে নিজের কথা বসিয়ে গেয়ে শোনালেন থানার অফিসার ইন চার্জ নিজে। চমৎকার গাইলেন সন্দেহ নেই, কিন্তু হাঁচি, কাশি হলে হাসপাতালে যাওয়ার যে পরামর্শ গানের মধ্যে দিয়ে দেওয়া হলো, তাতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ভারত সরকার, এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকাও মানা হলো না।

স্বেচ্ছা অন্তরীন থাকাই যেখানে করোনা সংক্রমণের প্রসার রুখে দেওয়ার একমাত্র রাস্তা, করোনা নিশ্চিত না হলে হাসপাতালে না যাওয়াই যেখানে বিধেয় হয়েছে ভারতের মতো জনবহুল দেশে, যেখানে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রয়োজনের তুলনায় নেহাতই অল্প, সেখানে ওই উপদেশ আদৌ কতটা যুক্তিযুক্ত হলো, সেই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠছে।

পশ্চিমবঙ্গের ভালো ভাবমূর্তিই সবসময় তুলে ধরতে চান মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। এ কারণে রাজ্যে করোনা আক্রান্তের মৃত্যুর কারণ কখনো বিকল কিডনি, কখনো দুর্বল ফুসফুস, আবার কখনো ‘হার্ট ফেল’ বলে উল্লেখ করে প্রমাণ করার চেষ্টা হচ্ছে করোনার প্রকোপ রাজ্যে রুখে দেওয়া গেছে। কিন্তু অন্য কথা বলছেন চিকিৎসকরা।

তাঁরা বলছেন, যে কোনো মৃত্যুই শেষ পর্যন্ত হয় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলে। এমনকি মস্তিষ্কের মৃত্যু ঘটলে, একে একে সবকটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে গেলেও হৃদযন্ত্র যতক্ষণ চালু, ততক্ষণ মৃত্যু হয়নি ধরে নিতে হয়। অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা প্রশ্ন তুলছেন, তা হলে কি এখন থেকে পশ্চিমবঙ্গে যে কোনো মৃত্যুর কারণই হার্ট ফেল বলে লেখার বিধান দেওয়া হলো? নাকি বাস্তবকে অস্বীকার করার মধ্যে লুকিয়ে থাকলো বিপদ?

এই রাজ্যের চিকিৎসকরা, যাঁরা এখনো নিয়মিত রোগী দেখছেন, অস্ত্রোপচার করছেন, তাঁরা অনেকদিন ধরেই অভিযোগ করছেন, সংক্রমণ প্রতিরোধী পোশাক তাঁদেরকে দেওয়া হচ্ছে না। কিছু জায়গায় স্বাস্থ্যকর্মীরা বর্ষাতি পরে কাজ করছেন। গান না শুনিয়ে বরং এইগুলোর ব্যবস্থা করে রাখতে পারতো সরকার, যাতে জরুরি পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যকর্মীরা অন্তত নির্ভয়ে কাজ করতে পারেন। খবর: ডয়েচে ভেলে।