৫ করোনা রোগীকে সুস্থ করে সুখবর দিলেন মার্কিন গবেষকরা

  © ফাইল ফটো

করোনাভাইরাস শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে আগে ভেঙে দেয়। মানুষের শরীরের কোষে নিজেদের পছন্দের প্রোটিনকে বন্ধু বানিয়ে এরা আগে সেই কাজটাই করে। ভাইরাসের সংক্রমণ সারাতে গেলে তাই আগে রোগ প্রতিরোধের ভিতটা মজবুত করতে হয়। তার জন্য দরকার শক্তিশালী অ্যান্টিবডি যা ভাইরাস স্ট্রেনের প্রোটিনগুলোর সঙ্গে জমিয়ে লড়াই করতে পারবে।

ভ্যাকসিন বা ড্রাগ বানিয়ে যে কাজ অনেক সময়সাপেক্ষ, সেখানে বিকল্প হতে পারে রক্তরস বা প্লাজমা থেরাপি। কোভিড-১৯ সারিয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছেন যে ব্যক্তি তার প্লাজমা যাকে বলে ‘কনভ্যালসেন্ট প্লাজমা’, তাই দিয়ে সংক্রমিতকে সারিয়ে তুলে আশার আলো দেখিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের চিফ কোয়ালিটি অফিসার ফাহিম ইউনুস। 

করোনা সংক্রামিতের ওপর ‘কনভ্যালসেন্ট প্লাজমা থেরাপ’ প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত অনেকদিন আগেই নিয়েছে মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। সুস্থ ব্যক্তির রক্তরস দিয়ে আক্রান্তের চিকিত্‍সা পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা চলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীনে। করোনাযুদ্ধ জয় করতে সময়সাপেক্ষ ভ্যাকসিন বা ড্রাগের বদলে এখন প্লাজমাকেই হাতিয়ার করতে চলেছেন ডাক্তার-বিজ্ঞানীরা। সেই পথেই আলো দেখিয়েছেন ডাক্তার ফাহিম। নিজের অফিসিয়াল টুইটার হ্যান্ডেলে তিনি জানিয়েছেন, এই প্লাজমা থেরাপিতে এরই মধ্যে পাঁচজন সঙ্কটজনক রোগীকে সারিয়ে তোলা সম্ভব হয়েছ। তাদের মধ্যে তিনজন একদমই সুস্থ, হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বাকি দু'জনের অবস্থা স্থিতিশীল। এই সেরে ওঠাদের মধ্যে একজন তার প্লাজমা দান করতে ইচ্ছুক। 

সুস্থ ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি এমন ব্যক্তির প্লাজমা বা রক্তরস নিয়ে চিকিত্‍সার পদ্ধতি নতুন নয়। এই প্লাজমা থেরাপিকেই এবার সার্স-কভি-২ ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে কাজে লাগানো শুরু করেছেন গবেষকরা। শরীরে সংক্রামক জীবাণু ঢুকলে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এই রক্তরস। মানুষের শরীরের ৫৫ শতাংশ হলো প্লাজমা বা রক্তরস। হালকা হলুদাভ তরল যার ৯৫ শতাংশ পানি এবং ছয় থেকে আট শতাংশ বিভিন্ন প্রোটিন (অ্যালবুমিন, গ্লোবিউলিন, ফাইব্রিনোজেন), গ্লুকোজ, ইলেকট্রোপ্লেট, হরমোন ও আরও নানা উপাদান থাকে। এই রক্তরস অ্যান্ডিবডি তৈরি করে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারে ও যে কোনো সংক্রমণ আটকাতে পারে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, কোভিড-১৯ সংক্রমণ সারিয় সুস্থ হয়ে ওঠেছেন যে ব্যক্তি তার রক্তরস ভাইরাসপ্রতিরোধী অ্যান্টিবডি তৈরিতে সক্ষম হয়েছে। অর্থাত্‍ সার্স-কভ-২ ভাইরাল স্ট্রেনকে আটকাতে যে ধরনের অ্যান্টিবডি দরকার সেটা তৈরি হয়েছে রক্তরসে। কাজেই সেই সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তির রক্তরস যদি প্রয়োগ করা যায় আক্রান্তের শরীরে, তাহলে সেই অ্যান্টিবডিকে হাতিয়ার করেই রোগীর দেহকোষ লড়াই চালিয়ে যাবে ভাইরাসের বিরুদ্ধে। এই প্লাজমাকেই বলা হচ্ছে কনভ্যালসেন্ট প্লাজমা।  

জন হপকিনস ব্লুমবার্গ স্কুল অব পাবলিক হেলথের মলিকিউলার বাযোলজির প্রধান আরতুরো ক্যাসাডাভেল বলেছেন, প্লাজমা থেরাপিতে সংক্রমণ সারানোর উপায় আছে। সেরে ওঠা ব্যক্তিরা যদি প্লাজমা দান করতে এগিয়ে আসেন, তাহলে বাঁচানো যাবে বহু মানুষকে। নিউইয়র্কের মাউন্ট সিনাই হাসপাতালের ডাক্তার অ্যানিয়া ওয়াজানবার্গ বলেছেন, সেরাম-অ্যান্টিবডি প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে। হিউস্টনের মেথডিস্ট হাসপাতালে প্লাজমা দান করেছেন দাতারা। ওই হাসপাতালে প্রথম একজন কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগীর ওপরে সুস্থ ব্যক্তির প্লাজমা প্রয়োগ করা হয়েছে। তার অবস্থা অনেকটা স্থিতিশীল। 

কনভ্যালসেন্ট প্লাজমাথেরাপির প্রয়োগ হয়েছিল ২০০৩ সালে যখন সার্স মহামারি হয়েছিল। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রমণের সময়েও এই থেরাপির প্রয়োগ করেছিলেন ডাক্তাররা। ২০১২ সালে মার্স ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতেও কোথাও কোথাও এই প্লাজমা থেরাপির প্রয়োগ হয়েছিল। সব সংক্রমণ সারাতে পারবে এই থেরাপি এমনটা নয়, তবে অনেক সংক্রামক রোগ প্রতিরোধেই এই চিকিত্‍সাপদ্ধতির প্রয়োগ করা হয়েছে। 

ইউনিভার্সিটির অব গ্লাসগোর বিজ্ঞানী ডেভিড তাপ্পিন বলেছেন, প্লাজমা-থেরাপির ক্লিনিকাল ট্রায়াল নিয়ে অনুমোদন চাওয়া হয়েছে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের থেকে। অ্যাকাডেমি অব মেডিক্যাল সায়েন্স ও কিংস হেলথ পার্টনারের একজিকিউটিভ ডিরেক্টর অধ্যাপক রবার্ট লেচলারের মতোও তেমনটাই। আমেরিকা, ব্রিটেন, চীনে এই থেরাপি নিয়ে জোরদার গবেষণা চলছে। 

সূত্র: মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, ল্যানসেট মেডিক্যাল জার্নাল, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, দ্য ওয়াল।


সর্বশেষ সংবাদ