২৫ মার্চ ২০২০, ১৩:২৩

করোনা মোকাবিলায় কোরিয়ার যে মডেল এখন বিশ্বের অনুপ্রেরণা

  © ইন্টারনেট

গোটা বিশ্বের আতঙ্ক করোনাভাইরাস দক্ষিণ কোরিয়াতেও বিস্তার লাভ করেছে। তবে সেখানে এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পথে। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে তাদের লড়াই এখন সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তারা এখন গোটা বিশ্বের অনুপ্রেরণা, রোল মডেল।

জানা গেছে, খুব সহজলভ্য টেস্ট কিট, করোনা পরীক্ষার অত্যাধুনিক সুযোগ সঙ্গে প্রযুক্তি-কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার পৃথিবীর অনেক দেশের জন্যে কল্পনার বিষয়। কোরিয়া তা বাস্তবে প্রয়োগ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে সবাইকে। এই মডেলের প্রশংসা করছে বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থা- ডব্লিউএইচও।

করোনা পরীক্ষায় কোরিয়া অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। করোনা টেস্ট কিট এখন বিশ্বের আলোচনার বিষয়। বাংলাদেশের মতো আমেরিকা ও ইউরোপের বহু দেশের কাছেও পর্যাপ্ত কিট নেই। পূর্ব প্রস্তুতি না থাকলেও বিপদে পড়ে নানা রকমের অজুহাত সামনে আনা হচ্ছে।

সূত্র মতে, ২০১৫ সালে মার্স ভাইরাসের বিস্তারের সময় কোরিয়ান কিছু বায়োটেকনোলজি কোম্পানি গবেষণা শুরু করে। তখন সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতায় মার্স ভাইরাস শনাক্তের কিট উদ্ভাবন করে। সেই গবেষণা কাজে দেয় গত বছরের শেষের দিকে চীনের উহানে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর। কোরিয়ান কোম্পানিগুলো এর কিট উৎপাদনের শুরু করে। তখনও কোরিয়া করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি।

তারা দ্রুত কিট উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু করতে সক্ষম হয় সরকারি সংস্থা কোরিয়া সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (কেসিডিসি) তাৎক্ষণিক সহযোগিতায়। যেমন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র স্বল্পমূল্যের করোনাভাইরাস কিট উদ্ভাবন করেছে। কোরিয়ান গবেষকরা মার্স ভাইরাসের কিট তৈরি করেছিলেন। আর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডা. বিজন কুমার শীল সার্স ভাইরাসের কিট তৈরি করেন।

ঘটনাটি কোরিয়ার ক্ষেত্রে হলে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র কিট উৎপাদন ও ব্যবহার শুরু করে দিতে পারতো। ২০ কোটি টাকার জন্যে ব্যাংকের পেছনে ঘুরতে হতো না। এমনকি ইউএসএআইডির সঙ্গে মিটিংও করতে হতো না।

কোরিয়ান কিট প্রস্তুতকারক কোম্পানির মধ্যে PowerChek (Kogene Biotech, Korea), DiaPlexQ (SolGent, Korea), Anyplex (Seegene, Korea), AccuPower (Bioneer, Korea)- সহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠান করোনা টেস্ট কিট বাজারে এনেছে। সেগুলো দিয়ে ১০ মিনিট থেকে তিন ঘণ্টার মধ্যে পরীক্ষার ফল জানা যায়। জানা গেছে, টেস্ট কিট ব্যবহারের জন্য সর্বাধুনিক পিসিআর মেশিনও কোরিয়ার কিছু হাসপাতালে আগেই ছিল।

এখন নতুন করে আরও পিসিআর মেশিন দেওয়া হয়েছে। তাদের প্রতিদিন ২০ হাজারের বেশি করোনাভাইরাস পরীক্ষার সক্ষমতা আছে। অথচ বাংলাদেশে ২৪ ঘণ্টায় ৯২ জনের পরীক্ষা করা হয় বলে জানা গেছে।

কেসিডিসি সরাসরি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ল্যাবসহ সারাদেশে পর্যাপ্ত টেস্ট কিট পৌঁছে দিয়েছে। চাহিদা মতো সরবরাহ ও পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে কেসিডিসি প্রযুক্তির সবোর্চ্চ সহায়তা নিয়েছে। এছাড়া কোরিয়ানদের একবারও বলতে হয়নি ‘গুজব’ ছড়াবেন না। সরকারি আমলার কথা অসত্য, এমন মানসিকতাও ছিল না। কোরিয়ান সরকার কাজ দিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছে।

কোরিয়ান সরকার সব নাগরিকের বিনামূল্যে করোনা চিকিৎসা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। পরীক্ষাও বিনামূল্যে করা হচ্ছে। এমনিতেই জাতীয় স্বাস্থ্য বীমার আওতায় সবাই স্বল্প মুল্যে চিকিৎসা সেবা পেয়ে থাকেন। চিকিৎসক ও সেবা কর্মীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সরঞ্জাম (পিপিই) তারা জানিয়েছেন, টেস্ট কিটের মতো পিপিই নিয়েও কোনো আলোচনা নেই। ঘাটতিও নেই।

বিগত কয়েক সপ্তাহের দেশটির গণমাধ্যমে কিট বা পিপিই সংকট ও চিকিৎসা সেবা নিয়ে গাফলতি বা সীমাবদ্ধতার কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি। কিট ও মাস্ক প্রস্তুতকারক কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, সত্যিকারের যুদ্ধের মতো তারা কাজ করছেন। কিট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সিজেনির তথ্যানুয়ায়ী, ২৪ জানুয়ারি কাঁচামাল অর্ডার দেওয়ার চার দিনের মধ্যে তা পেয়েছে। ৫ ফেব্রয়ারির মধ্যে তারা টেস্ট কিটের প্রথম ভার্সন প্রস্তুত করে ফেলেছে।

প্রতিষ্ঠানটি সংগৃহীত ডাটার ভিত্তিতে বেশ কিছুদিন আগে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স-ভিত্তিক রিসার্চ সিস্টেম ডিজাইন করে, যা করোনার কিট প্রস্তুতে কাজে লাগায়। ফেব্রয়ারিতে কোরিয়ায় করোনা আক্রান্তদের সংখ্যা বাড়ায় প্রেসিডেন্ট মুন জে ইনের তৎপরতা ছিল দেখার মতো। এতে তার জনপ্রিয়তা বেড়েছে। তিনি কিট তৈরিতে কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করেছেন।

কিছু কোরিয়ান প্রতিষ্ঠান দেশের বাইরেও কিট রপ্তানির অনুমোদন পেয়েছে। প্রতিটি টেস্ট কিট প্যাকেজের মূল্য ১০ থেকে ১৫ মার্কিন ডলার।

১০০টিরও বেশি দেশ কোরিয়ানদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও তাদের সরকার কোনো দেশের নাগরিকদের কোরিয়া ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। বিমানবন্দরে আসা যাত্রীদের কিউআর কোড দিয়ে অ্যাপ ডাউনলোড করা বাধ্যতামূলক। অ্যাপে সবাই প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে স্বয়ংক্রিয় থার্মাল মেশিনে চেক করছেন। উপসর্গ না পেলে বের হয়ে আসছেন। অ্যাপের মাধ্যমেই ১৪ দিন ওই ভ্রমণকারীকে ট্র্যাকিংয়ে রাখছে সরকার। আর উপসর্গ পেলে বিমানবন্দরেই পরীক্ষা করে আইসোলেশনে নিয়ে চিকিৎসা করা হচ্ছে।

প্রেসিডেন্ট মুন জে ইন বলেছেন, ‘কোরিয়া মানুষের মৌলিক অধিকারকে অগ্রাধিকার দেয়। চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার সবার আছে। আমাদের যুদ্ধ রোগের বিরুদ্ধে, মানুষের বিরুদ্ধে নয়।