পাপিয়াকে যেমন সহযোগিতা করার লোক ছিল, তাকে রক্ষা করার লোকও ছিল

  © টিডিসি ফটো

বাংলাদেশের শামীমা নূর পাপিয়া কী ভয়ানক কী কুৎসিত কী বীভৎস সব কীর্তি করেছে। দেহ ব্যবসা, জুয়ো ব্যবসা, মাদক ব্যবসা, অর্থ পাচার ইত্যাদি নানা ধরনের অবৈধ ব্যবসা করে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছে। এইসব চুরি জোচ্চুরি বদমায়েশি, এইসব লুটপাট, লোক ঠকানো, অন্যায় অত্যাচার- পুরুষেরাই করে বলে লোকে বিশ্বাস করতো। এখন দেখছে সুযোগ পেলে মেয়েরাও করে এসব।

এই যে গত চার দশক থেকে বলে আসছি নারী আর পুরুষে আসলে কোনও পার্থক্য নেই। আমার কথা তো কেউ মানেনি। এখন মানবে তো! নারী এবং পুরুষের শারীরিক গঠনে কিছুটা পার্থক্য আছে, এই পার্থক্য নিয়েই পুরুষেরা যা করতে পারে, নারীও করে দেখিয়েছে, নারীও পারে। নারী সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী সব বাহিনীতেই বিদ্যমান। সম্মুখ সমরেও তারা। কুলির কাজ, কৃষিকাজ, কন্সট্রাকশনের কাজ কী না করে নারী! নারী এভারেস্টের চূড়োয় গিয়েও উঠতে পারে। পারে না?

যে কাজে মস্তিষ্কের ব্যবহারই প্রধান, সেই কাজেও নারী তার পারদর্শিতা দেখিয়েছে। পরীক্ষায় ভালো ফল করছে নারী। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বৈমানিক, বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ী, নভোচারী, নেত্রী, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী কী না হতে পারে নারী! নারী মেধাবী, পারদর্শী, দক্ষ, বিচক্ষণ। নারী কিন্তু পুরুষের মতোই, পুরুষ যেমন খারাপ কাজ করতে পারে, নারীও পারে। অন্যায় অত্যাচার, অবৈধ ব্যবসা, অর্থ আত্মসাৎ, প্রতারণা, মারামারি খুনোখুনি সবই নারী পারে। নারীকে এসবে ততটা দেখা যায় না, কারণ সুযোগ নেই। নারীর মনে পুরুষের মনের মতোই হিংসে, দ্বেষ, লোভ, লালসা। চতুরতা ধূর্ততা পুরুষের একার নয়, নারীরও।

পাপিয়া যে পাপাচারে লিপ্ত ছিল, তা অনুমান করছি এতকাল ধরে সম্ভব হয়েছে, কারণ তাকে যেমন সহযোগিতা করার লোক ছিল, তাকে রক্ষা করার লোকও ছিল। তারা নিশ্চয়ই ছোটখাটো কেউ নয়। বড়সড় সহযোগিতা থাকলেই বড়সড় অন্যায় করা যায়। এই সহযোগী, রক্ষাকারীদের নাম নিশ্চয়ই তদন্ত করলে পাওয়া যাবে। তাঁদের নাম শেষ অবধি প্রকাশিত হবে কিনা, সংশয় থেকেই যায়। এইসব বড় খেলায় ছোট খেলোয়াড়রা ধরা পড়ে, নেপথ্যের বড় খেলোয়াড়রা ধরা পড়ে না। তারা অতি ক্ষমতাশালী বিত্তশালী বলশালী কিনা। এসব কাহিনি দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে আমরা কি ইতিমধ্যে ক্লান্ত হইনি? শুনেছি হাজার কোটি টাকা চুরি করে লোকেরা দেশ থেকে পালাচ্ছে। এই হাজার কোটি টাকা লোকেরা কী করে উপার্জন করছে? কী করেই বা ব্যাংক লুট হচ্ছে। সাধারণ মানুষ তো তা পারবে না। আমি পারবো? আমি ব্যাংক থেকে একটি টাকাও ধার নিতে পারবো? হোটেলের সুইট ভাড়া করে দিনের পর দিন কোনও হোটেলে থাকতে পারবো আমি? হোটেলে বসে সুন্দরী মেয়েদের এস্কর্ট সার্ভিস চালিয়ে যেতে পারবো? হোটেলের ভেতরেই দেহ ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবো? মাদক ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবো? পারবো না। হোটেলের লোকেরা সেদিনই জেনে যাবে। এবং আমাকে সেদিনই জেলে যেতে হবে। অন্য যে কোনও সাধারণ মানুষের বেলায়ও তা-ই হবে। কিন্তু পাপিয়ার বেলায় সবাই গোপন রেখেছে তাঁর কীর্তিকলাপ। কারণ পাপিয়া যুব মহিলা লীগের নেত্রী ছিলেন। তাঁর আশ্রয় ছিল, প্রশ্রয় ছিল। নিশ্চয়ই ছিল। ছিল বলেই তিনি অবৈধ অনৈতিক অন্যায় করে যেতে পেরেছেন দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। নিজের পদের তিনি অপব্যবহার করেছেন। সরকারের ছত্রছায়ায় ভয়ংকর ভয়ংকর সব অন্যায় ঘটে যেতে পারে। ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ বললেই যদি তাকে কাছের মানুষ, বিশ্বাসযোগ্য মানুষ, নিজের মানুষ বলে ভাবা হয় তাহলে মুশকিল। অর্থলোভ মানুষকে অমানুষ করে তুলছে। এই লোভের শিকার নারী পুরুষ উভয়েই।

আজ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা পড়শি দেশগুলো থেকে, এমন কী ভারতের থেকেও ভালো। বাংলাদেশের মোট দেশীয় পণ্য বৃদ্ধির হার এখন ৮.১, যেখানে বিশাল ভারতবর্ষের মাত্র ৬.৬। কী লাভ অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হয়ে, যদি অর্থকড়ি দেশের কাজে না লেগে ব্যক্তির ভোগ বিলাসের কাজে লাগে! রাজনৈতিক দলে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্য, কিছু মানুষের জন্য, ধনী হওয়া বা নিজের আখের গোছানো। খুব কম লোকই রাজনীতিক হিসেবে দেশ এবং দেশের মানুষের সেবা করার কথা ভাবে। একদিকে নামাজ রোজা করছে, হজ করছে, কিন্তু আরেকদিকে অন্যের অর্থ আত্মসাৎ করছে, প্রতারণা করছে, মানুষের সর্বনাশ করছে। মনে হচ্ছে যত ধর্ম বাড়ছে, তত অনাচার বাড়ছে। আমার মনে হয়, অনেকে মনে করে, গুনাহ করছি তাতে ক্ষতি কী, ওপরওয়ালার কাছে ক্ষমা চাইলে ক্ষমা করে দেন, অবসর মতো ক্ষমা চেয়ে নেবো।

আমার মনে হয় পাপিয়া ততদিন তার সাম্রাজ্য রক্ষা করতে পেরেছে যতদিন তাকে সেটি রক্ষা করতে দেওয়া হয়েছে। যেদিন থেকে তাকে আর রক্ষা করতে দেওয়া হয়নি, সেদিন থেকে তিনি পুলিশের হেফাজতে। পাপিয়ার অবৈধ ব্যবসা, অবৈধ অর্থ উপার্জন সম্পর্কে সরকারের কেউ জানতো না, যে যতই বলুক, এ বিশ্বাস করার মতো নয়।

কোনও অন্যায় করিনি, কোনও অনৈতিক কাজ করিনি, কারও কোনও ক্ষতি করিনি, কারও সঙ্গে প্রতারণা করিনি, কোনও চুরি ডাকাতি করিনি, অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করিনি, কাউকে খুন করিনি, শুধু মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করতে চেয়েছিলাম, মানুষকে নারীর প্রাপ্য অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে চেয়েছিলাম, সমতার সমাজ চেয়েছিলাম, সেটিকে অপরাধ ভাবলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমাকে তো দেশে ঢুকতে দিচ্ছেনই না আজ ২৫ বছর, আমার পাওয়ার অব অ্যাটর্নির কাগজ সত্যায়িত না করার জন্য বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোকেও বলে রেখেছেন। অথচ অজস্র চাটুকার পুষছেন, যাদের মধ্যে অনেকেই বিশ্বাসঘাতকতা করছে, যারা দেশ ও দেশের মানুষের সর্বনাশ করছে, আওয়ামী লীগের সুনাম নষ্ট করছে, সে কারণে প্রধানমন্ত্রীর শাসনব্যবস্থাও বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

পাপিয়া ধরা পড়েছে বলে আমরা পাপিয়ার খবর জানি। আমরা নিশ্চয়ই অনেকের খবর জানি না, যারা সরকারি দলের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার নেতানেত্রী, কিন্তু জনগণের চোখ ফাঁকি দিয়ে লুটতরাজ করছে। পাপিয়া হয়তো খানিকটা অদক্ষ বদমাশ ছিল, সে কারণে ধরা পড়েছে। যারা তার চেয়ে বেশি দক্ষ, বেশি ধূর্ত, তাদের ধরা সহজ নয়। সমগ্র বাংলাদেশে এক পাপিয়াই তো বদ কাজ করছিল না, বদ কাজ আরও লোক করছে। সরকারি বা ধনাঢ্য লোকদের ছত্রছায়ায় থেকে বদ কাজ করার লোকের অভাব কি কোনওদিন কোনওকালে হয়েছিল?

সরকার কিন্তু চাইলে বন্ধ করতে পারে এইসব প্রতারণা, লুটতরাজ, আর অর্থ পাচার। সরকার চাইছে না কেন সেটিই বড় প্রশ্ন। রাজনৈতিক দলে নাকি কিছু বদ লোককে রাখতে হয়। কিন্তু বদ লোককে রাখতে গিয়ে মুশকিলও হয়। বদ লোকের সংখ্যাটা খুব বেড়ে যেতে থাকে। লোভ-লালসা বড় সংক্রামক। একজনের লোভ দেখে আরেকজনের লোভ বাড়ে। আদর্শের রাজনীতি আজকাল যে অল্প কজন করে, তারা অনেকে আমার মতোই অসহায়। সরকারের শীর্ষে যারা তারা হয়তো তাদের পছন্দও করেন না, আমাকে যেমন করেন না।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।