সাগরে লুঙ্গি ফুলিয়ে ভেসেছিলেন ইমরান, ৬দিন পর উদ্ধার

‘পানি তুলতে গিয়ে স্রোতের তোড়ে ট্রলার থেকে পড়ে যাই, মুহূর্তের মধ্যে আমাদের ট্রলার ভেসে অনেক দূরে চলে যায়। সাগরে পানিতে ভাসতে থাকি। আস্তে আস্তে শরীরের শক্তি যেন কমে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর নিজের পরনের লুঙ্গি ফুলিয়ে ভাসতে থাকি। শক্তি ছিল না, মরেই গেছিলাম। এই দুনিয়ার আলো আবার দেখতে পারবো ভাবতেই পারিনি!’

এ কথাগুলো সেই কিশোর ইমরান হোসেনের। বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার চরদুয়ানী মাধ্যমিক বিদ্যলয়ের ছাত্র ইমরান, তার বাবার নাম মো. ইয়াহিয়া। তার মায়ের নাম আসমা বেগম। ইমরান যখন দুই মাসে তখন তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে যায়।

ইমরান এখন এক সাহসী যোদ্ধার নাম। সে কোনো সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেওয়া যোদ্ধা নয়, যে কিনা গভীর সমুদ্রে জীবনযুদ্ধ করেছে। ছয়দিন পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে ভাসতে ভাসতে ভারতীয় জলসীমায় প্রবেশ করলে ভাসমান অবস্থায় তাকে ভারতীয় জেলেরা উদ্ধার করেন।

শখের বসে নানার ট্রলারে সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে ট্রলার থেকে ছিটকে পড়ে যায় ওই কিশোর। সাগরে লুঙ্গি ফুলিয়ে ভাসতে ভাসতে ভারতে যাওয়া সেই ইমরান ১৭২ দিন পরে দেশে ফির আসে। দীর্ঘ আইনি বেড়াজাল ও কূটনৈতিক যোগাযোগের পর শুক্রবার (১৪ ফেরুয়ারি) তাকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) বেনাপোল সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কাছে বিকেল ৪টা ২০মিটিটে হস্তান্তর করে। এ সময় ইমরানের নানা ও মামা তাকে বেনাপোল থানার মাধ্যমে গ্রহণ করে। ইমরান ছয়মাস পরে ফিরে আসার পরে বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশীরা ভিড় জমান।

বিভীষিকাময় সেই জীবনযুদ্ধের বর্ণনা দেন ইমরান। বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে ইমরান। সেই ঘটনা মনে আনতেই অজ্ঞানপ্রায় হয়ে পড়েন সে। এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি ইমরান। সে বলে, সকাল ৬টার দিকে ট্রলারের সবার খাবারের প্রস্তুতি নিছিল। আমি সবার হাত ধোয়ার জন্য বালতি দিয়ে পানি তুলতে গিয়েই পড়ে যাই। মুহূর্তের মধ্যে আমাদের ট্রলার সরে যায়। গভীর পানিতে ভাসতে থাকি, কয়েক ঘণ্টা যাওয়ার পর হঠাৎ মনে পরলো ছোটবেলার কথা, মুহূর্তের মধ্যেই লুঙ্গি ফুলিয়ে ভাসতে থাকি। ভাসতে ভাসতে কোথায় গেছি বলতে পারি না। কতদূর যাওয়ার পর বড় বড় ডলফিনের মতো মাছের দেখা মেলে, ভাবছিলাম ওরা আমারে খেয়ে ফেলবে, কিন্তু না... আমারে ওরা কোনো ক্ষতিই করেনি। এভাবেই পার হলো কয়েক ঘণ্টা।

এরপর ট্রলারে হাত থেকে ছুটে যাওয়া রশিতে বাঁধা অবস্থায় ফ্লুটসহ বালতি, সেটি ধরে ভাসতে থাকি। ততক্ষণে পর আমার শরীরের শক্তি শেষ হয়ে গেছে। তখন ভাবছিলাম, এখনই বুঝি মারা যাবো, আর মনে হয় দুনিয়ায় থাকতে পারমুনা, মায়ের কাছে যাইতে পারমুনা। এভাবেই চলতে থাকলো কয়েকদিন, ছয়দিনের মাথায় শনিবার (৩১ আগস্ট) ভারতীয় একটি মাছ ধরা এফবি বাবা পঞ্চানন ট্রলারের চালক মনোরঞ্জন দাসসহ দুইজন জেলে আমাকে দেখে সাগরে ঝাঁপ দিয়ে উদ্ধার করেন। তখন আমার কোনো হুঁশ (জ্ঞান) ছিল না। ট্রলারে উঠিয়ে আমাকে খাবার দিয়ে সুস্থ করেন তারা। এরপর ভারতের জেলে সমিতিতে নিয়ে যায় আমাকে, সেখান থেকে আমাকে রায়দিঘি থানায় পরে ভোলাহাট থানার নূর আলী মেমোরিয়াল সোসাইটি নামে একটি শিশু যত্ন ও শিশু সুরক্ষা কেন্দ্রে রাখে। দীর্ঘ ৬ মাস হোমে থাকি। গত ২৬ আগস্ট একটি মাছ ধরার ট্রলারে চড়ে ইমরান সাগরে গেলে সামুদ্রিক ঝড়ে সে ছিটকে পড়ে যায়।

বরগুনার জেলা প্রশাসকসহ তার স্বজনরা তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করেছেন। জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ ইমরানের বেঁচে থাকাকে অলৌকিক এবং এই দিনে দেশে ফেরা দুই প্রতিবেশী দেশের জনগণের ভালোবাসা বলে অভিহিত করেন।


সর্বশেষ সংবাদ