সমাজ বাস্তবতার এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি আবুল মনসুরের ‘আয়না’

‘আয়না’ গ্রন্থের প্রচ্ছদ এবং চবি শিক্ষার্থী রাকিব
‘আয়না’ গ্রন্থের প্রচ্ছদ এবং চবি শিক্ষার্থী রাকিব  © টিডিসি ফটো

আবুল মনসুর সম্পর্কে কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘হাসির পিছনে যে অশ্রু আছে, কামড়ের পিছনে যে দরদ আছে, তা যারা ধরতে পারবেন, আবুল মনসুরের ব্যঙ্গের সত্যিকার রসোপলব্ধি করতে পারবেন তাঁরাই। বন্ধুবরের এ রসাঘাত কষাঘাতেরই মত তীব্র ও ঝাঁঝালো।”

আবুল মনসুর আহমদ তাঁর ছোটগল্পে রঙ্গব্যঙ্গ ও হাস্যরসের মাধ্যমে সমাজের নানামাত্রিক গলদ ও অসংগতি ও ভণ্ডামি দেখানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি ছিলেন একজন রাজনীতি ও সমাজ সচেতন লেখক। তাঁর ছোটগল্পের দিকে তাকালে আমরা যে অসংগতি দেখতে পাই সেগুলো আজও আমাদের সমাজে বিদ্যমান। সে সূত্রে আবুল মনসুর আহমদের ‘আয়না’ আমাদের কাছে অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক।

এই গ্রন্থে সাতটি গল্প বর্ণিত রয়েছে। সবগুলো গল্পেই আমরা পাবো সমাজের দীর্ঘদিন ধরে গেঁথে বসা বাস্তব সব চিত্র। দেখবো হিন্দু মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। দেখবো এই বঙ্গের মানুষের ধর্মকে আশ্রয় করে নিজেদের স্বার্থোদ্ধর করার চিত্র। ‘হুযুর কেবলা, গো-দেওতা কা- দেশ, নায়েবে নবী, লীডরে কওম, মুজাহেদিন, বিদ্রোহী সংঘ, ধর্ম রাজ্য- এসব গল্পে আমরা হাস্যরস ও রঙ্গব্যঙ্গের মাধ্যমে সমাজের বাস্তব চিত্রই দেখতে পাবো প্রতিটি ছোটগল্পের পরতে পরতে।

‘হুযুর কেবলা’ আবুল মনসুর আহমদের একটি উল্লেখযোগ্য গল্প। ১৯২০ এর দিকে রচিত ও প্রকাশিত হয়েছে আলোচ্য গল্প। আজ থেকে শতবর্ষ পূর্বে এই গল্প রচিত হলেও এর প্রাসঙ্গিকতা বিদ্যমান।

এই গল্পে বাংলাদেশের গ্রামজীবনে প্রবলভাবে জেঁকে বসা পীব ব্যবসার বৃত্তান্ত বর্ণিত হয়েছে। ধর্মকে আশ্রয় করে কীভাবে একশ্রেণির মানুষ তাঁদের স্বার্থোদ্ধার করে তারই চিত্র এ গল্প।এক ভণ্ড পীর,পীরের কতিপয় সাগরের, তাঁদের ভণ্ডামি ও মিথ্যাচার, পীরের রিরংসাবৃত্তি চরিতার্থ করার শঠ-কৌশল এবং এক প্রতিবাদী যুবকের আখ্যান শিল্পিত হয়েছে আলোচ্য গল্পে। সমাজে প্রচলিত পীরপ্রথার ভয়ংকরতা যেভাবে এই গল্পে শিল্পিতা পেয়েছে, ডলতা একটা ব্যাধি থেকে মুক্তির বাসনায় আকুল। এই মিথ্যাচার, ভণ্ডামি ও ধর্মব্যবসা থেকে সমাজ এখনো মুক্ত হয়নি। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু (১৯৪৮) উপন্যাসে মজিদ চরিত্রের মাধ্যমে আমরা ‘হুযুর কেবলা’ ছোটগল্পের একটি প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই।

‘গো-দেওতা কা-দেশ' আবুল মনসুর আহমদের একটি শিল্প সফল গল্প। সাম্প্রদায়িকতার যূপকাষ্ঠে কিভাবে দুটি জাতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যেতে পারে তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই গল্পটি। লেখক হিন্দু ও মুসলমান এই দুটি জাতির মধ্যকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার একটি স্পষ্ট চিত্র এই গল্পে তুলে ধরেছেন। হিন্দুদের গো মাতার মাধ্যমে তৎকালীন সময়ের এই দাঙ্গার চিত্র আমরা এই গল্পে লক্ষ্য করবো। লেখক স্বপ্নের মাধ্যমে যে চিত্র অঙ্কন করেছেন গল্পটি পাঠে তা মনে হবে পুরোপুরি বাস্তব। হিন্দু ও মুসলমানের সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ থেকে আমরা আজও মুক্ত হতে পারেনি। আবুল মনসুর আহমদের প্রতিটি গল্পই বর্তমান সময়ের সাথে প্রাসঙ্গিক।

বর্তমানের প্রাসঙ্গিকতা থেকে একটুও যেন বদল হয়নি আবুল মনসুর আহমদের প্রতিটি ছোটগল্প।তাঁরই উৎকৃষ্ট উদাহরণ 'নায়েবে নবী 'গল্পটি। হাস্যরসের মধ্য দিয়ে তিনি এই অঞ্চলের আর্থ সামাজিক চিত্র অর্তন্ত্য সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। গল্পে দেখা যায়, গ্রামের সরদার মৌলভী সুধারানী সাহেব এবং প্রতিদ্বন্দ্বী মৌলভী গরিবুল্লার প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব- সংঘাতের চিত্র।

মৌলবির ইতিহাস জ্ঞানের অভাব, একজনের মৃত্যুতে কিভাবে জানাজা পড়া হবে তা নিয়ে দুই মৌলভীর বাহাস, জুতা পেটাপেটি, ইমামতি নিয়ে কাড়াকাড়ি, ধাক্কাধাক্কি, পরে মাতব্বরের মধ্যস্থতায় জানাজা। গল্পটি রঙ্গরসপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও গ্রাম বাংলার এক আর্থ-সামাজিক বাস্তবতারই আলেখ্য।গ্রামের একজন মানুষের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে মৌলবীদের মধ্যে যে বিবাদের চিত্র তিনি হাস্যরসের মধ্য দিয়ে দেখিয়েছেন তা সত্যিই অতুলনীয়।

লীডারে-কওম’ বর্ণিত হয় একাধারে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ভণ্ডামির কাহিনী, আহলে-হাদীস ও হানাফিদের বিবাদ, হানাফি-মোহাম্মদীর বাহাস। ওই সুযোগে ইসমাইল সাহেবের ‘আহলে-হাদিস-গুর্য’ নামক পত্রিকা প্রকাশ, হানাফি-নিন্দার সঙ্গে সঙ্গে কিছু ইংরেজ নিন্দা ও ইসমাইল সাহেব কর্তৃক পত্রিকার মালিকানা গ্রহণ, মজহাবি-ঝগড়া বিবাদের নিন্দা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে ‘মুসলমান সম্প্রদায়ের তুলনা, এহ্তেকাফের সাহায্যে ‘মুসলিম বঙ্গের’ অদ্বিতীয় নেতা হযরত মওলানা সাহেবের ‘অঞ্জুমান-তবলিগুল-ইসলাম’ নামক আঞ্জুমান কায়েম, সর্বত্র শাখা স্থাপন, চাঁদা আদায়, বন্যায় রিলিফের জন্যে টাকা সংগ্রহ, খেলাফত আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ, আহলে হাদিস কনফারেন্স, স্বরাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, টাকা পয়সার হিসাবে গোলমাল তবলিগ, আঞ্জুমান ও খেলাফত নেতা মওলানার কংগ্রেসের অন্যতম প্রধান নেতায় উন্নতি, গ্রেফতার, কারাদণ্ড কিন্তু স্বাস্থ্যগত কারণে তিন মাসের মধ্যে মুক্তি এবং স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্যে রাঁচি গমন। ‘লিডারে কওম’কে অবিভক্ত বাংলার একজন স্বনামধন্য মুসলমান নেতার ‘জীবনপঞ্জী’ বললে ভুল হবে না। আবুল মনসুর আহমদ ওই মওলানা সাহেবে সংবাদপত্রে চাকরি করেছেন সুতরাং তার উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করেন, স্বাভাবিকভাবেই ‘লিডার কওম’-এর চরিত্র বুননে মুন্সিয়ানার পরিচয় মিলে।

‘মুজাহেদিন’ ধর্মীয় ভণ্ডামির কাহিনী, কিভাবে এক অঞ্চলের মধ্যে হানাফি ও মোহাম্মদী উভয় সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ বসবাসকে এক বহিরাগত মওলানা বাহাসের মাধ্যমে সাস্প্রদায়িক সংঘাতে পরিণত করে এবং উভয়পক্ষে সংঘর্ষ ও গ্রেপ্তার, পুলিশি তদন্ত, পরিণামে গ্রামের প্রায় সকলের জেল জরিমানা। আর ওদিকে উভয় সম্প্রদায়ের মওলানার বাহাস সভার বিবরণ সম্বলিত দুইটি পৃথক পুস্তিকায় উভয় পক্ষের জয় দাবি। ‘মুজাহেদিন’রা খেলাফত আন্দোলন আর পরবর্তী সময়ে সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিক ইংরেজের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে, দেশ ছেড়ে আফগানিস্তানে আর বাংলার মুসলমান সমাজে হানাফি-ওয়াহাবি, সংঘাত বাধিয়ে মুসলমানরা হয় সর্বস্বান্ত।

‘বিদ্রোহী সংঘ ’ ইংরেজ বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবী দলের কর্মী ও নেতার স্ববিরোধীতার স্যাটায়ার। ‘ধর্ম-রাজ্য’ হিন্দু ও মুসলমানের সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও ইংরেজের ভূমিকার আক্ষরিক চিত্র। দেখা যাচ্ছে ‘আয়না’ গ্রন্থে তিনি যেমন ধর্ম ব্যবসায়ী ফতোয়াবাজ মৌলবাদী ও স্বার্থপর, সুবিধাবাদী রাজনীতিক তেমন বাংলার দুই প্রধান সস্প্রদায় হিন্দু ও মুসলমান সমাজের সাম্প্রদায়িকতাকে সমান তীব্রতার সঙ্গে ব্যঙ্গ, পরিহাস, সমালোচনা করেছেন।

লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ