বুক রিভিউ: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অশনি সংকেত’

  © টিডিসি ফটো

স্বাধীনতার পূর্বে ভারতবর্ষে অবিভক্ত বাংলায় ধনী-দরিদ্র সব মানুষের ভিতর এক অদ্ভুদ দানা বেধেছিল। সেই অহংকার ছিলো প্রাচুর্যের। গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ ইত্যাদি। এমন বিবরণ শুনে কখনও কারো মনে হবে না যে কেউ না খেয়ে অনাহারে দিন পার করেছে। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! ছিয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের পর মানুষ আবার জানলো যে দুমুঠো ভাতের কত মুল্য।

উপন্যাসে নতুন গায়ে প্রথম যেদিন মতি নামের একটা মেয়ের চিতা জ্বলে উঠলো সেদিন গায়ের লোক বুঝতে পারলো ধ্বংশের সংকেত। অনাহারের আগুনে ছাই হয়ে যাওয়া লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষের বিনাশের অশনি সংকেত।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসমাপ্ত উপন্যাস হলো অশনি সংকেত। এই উপন্যাস ছিলো ভারতের জন জীবনের চিত্র।যেখানে স্পষ্টভাবে বোঝানো হয়েছে একটা এলাকার মহামারীর কথা। যা মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে করে তুলে ছিলো বিপন্ন। চারিদিকে শুধু হাহাকারের সুর।

গঙ্গাচরণ নামে এক শিক্ষিত ব্রাহ্মণ তার স্ত্রীর সাথে নতুন গায়ে বাস শুরু করেছিলো। গ্রামখানীতে তারাই একঘর শুধু ব্রাহ্মণ ছিলো। বাকি সবাই কপালি ও গোয়ালা। সুযোগ বুঝে ব্রাহ্মণ সকলের প্রতি নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রামের লোক তাকে মাথায় করে রাখেন। তার স্ত্রী ছিলো বেশ ভালো। সকলের সাথে ভালো ভাবে মিশতেন। কোমল হ্নদয়ের অধিকারী ছিলেন তিনি। যাকে সবাই নির্দিধায় ভরসা করতে পারে। সব মিলিয়ে সুখেই তাদের দিন কাঠছিলো। কিন্তু এই সুখ তাদের কপালে বেশিদিন সইলো না। হঠাৎ বিশ্বে নেমে আসা দ্বিতীয় যুদ্ধের হাওয়া তাদের গায়ে লাগলো। যুদ্ধের হাওয়া লাগাতে বদলে গেলো তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন।

দেখতে দেখতে বাজারের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতি দেখা দিলো। চোখের পলকে ৫ টাকায় ধানের মণ ২৫ টাকা হয়ে গেলো। মানুষের হাতে টাকা-পয়সা থাকা স্বত্তেও দ্রব্যাদি পাওয়া যেতো না। পাওয়া যাবেই বা কিভাবে বিশ্বের গোলযোগের কারণে সকল প্রকার দ্রব্যের আমদানি-রপ্তানী বন্ধ হয়ে গেলো। আর গ্রামের বিত্তশালী গৃহস্থ মানুষগুলো তাদের জমানো চাল- ডাল মজুদ করা শুরু করে দিলো যা সমাজের নিন্মবিত্ত মানুষের জন্য হয়ে আরো ভয়াবহ রুপ ধারণ করেছিলো।

প্রথম দিকে বামুন আর তার পত্নীর সংসার কোনভাবে চলে যাচ্ছিলো। কিন্তু এসময়ে বামুনের কোল জুড়ে আসে এক নবজাতক। গ্রামের একমাত্র বামুন হিসাবে সকলের প্রিয় হওয়াতে অনেকেই ভালোবেসে এটা-সেটা দিতো তাদের। কিন্তু পুরো দেশ দুর্ভিক্ষ কবলিত হওয়াতে গ্রামের মানুষ সকল প্রকার উপঢৌকন দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এতে আরো বিপাকে পড়ে ব্রাম্মণ।

অশনিসংকেত উপন্যাসটি মুলত ১৯৪৩-১৯৪৪ এর সময়ের চিত্র। অখণ্ড ভারত তখন যুদ্ধের হাওয়ার পরশে লন্ডভন্ড।কেননা যুদ্ধের রসদ যোগাতে বৃটিশ সরকার তখন ভারতের খাদ্যাভান্ডারে হাত দেয়। আর তা খুব দ্রুতই শুন্য করে দিলো ভারতবর্ষের অন্নভান্ডার। সেই সময় যাদের ঘরে কম বেশি চাল-ডাল ছিলো তারা তাদের নিজেদের প্রয়োজনে নিজেরাই মজুদ করে রেখে দিতে লাগলো আর অন্যরা আরো বিপদ গ্রস্ত হতে লাগলো।

ধীরে ধীরে গ্রামের পর গ্রাম মানুষ তাদের চাল শেষে অভাবে ভাতের আশা ছেড়ে দিয়েছিল। এ অবস্থায় তারা কচুর ডগা, শাক, মেটে আলু, ইত্যাদি খাওয়া শুরু করলো। কিন্তু একটা পর্যায়ে তাও শেষ হয়ে গেলো। একটা পর্যায়ে এলাকার মানুষ পুকর বা নদী থেকে গুগলি শামুক তুলে খাওয়া শুরু করলো। এরই কিছু পরে দিনে দিনে মানুষ অনাহারে থাকতে শুরু করে। অপঃপর দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে না খেয়ে মানুষ মারা যেতে শুরু করলো।

তখনকার সময়ে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ মারা গেলো ওই দুর্ভিক্ষে। মানুষ তার নিজের গোড়ামী আত্নদম্ভ, হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার সবকিছু ভুলে গিয়ে এক নাম মানুষ হিসাবে বাঁচতে শুরু করলো। তাদের ভিতর আর কোন ভেদাভেদ রইলো না। ঠিক এই চিত্রই বিভূতিভূষণ তার অশনি সংকেত উপন্যাসে তুলে ধরেছেন।

উপন্যাসিক একটা পর্যায়ে এসে সকল মানুষের মধ্যে মানবিকতার নিদর্শন জাগ্রত করেন, একটা পর্যায়ে এসে যখন মানুষ মরা শুরু করে ঠিক তখন নিজ জাত ভুলে যায় যা উপন্যাসে দেখতে পাই। ‘তথাকথিত একজন নিচু জাতের মহিলা মারা গেলে গঙ্গাচারণ মানবতার খাতিরে তার ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ত্যাগ করে মহিলার সৎকার করে’।

অশনিসংকেত মানে বজ্র বিপদ যা বয়ে গেছিলো জন জীবনের উপর দিয়ে। ১৯৪৩ সালের সেই দুর্ভিক্ষ লেখক প্রকাশ করলেন অশনিসংকেতের মাধ্যমে। অশনিসংকেত কোন কাল্পনিক গল্প নয়।

উপন্যাসিক পরবর্তীতে প্রজন্মের কাছে সেই দুর্ভিক্ষের কথা পৌঁছে দিতেই অশনিসংকেত নির্মাণ করেছেন। যেখানে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন খাদ্যের অভাবে মৃত্যু বরণ করার যন্ত্রণা। চোখের সামনে একে অপরের মৃত্যুলীলা। কিভাবে একটি এলাকা কয়েকদিনের মধ্যে মৃত্যুকুপে রুপান্তরিত হতে পারে।

লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়