বুক রিভিউ: ওবায়েদ হকের ‘নীল পাহাড়’

‘নীল পাহাড়’ উপন্যাসের নামটি উপন্যাসের কাহিনীর মতোই রহস্যময়। আর তার চেয়েও বেশি রহস্যময় উপন্যাসের লেখক ওবায়েদ হক। অচেনা অজানা এই লেখককে নিয়ে ব্যাপক আলোচনার ফলস্বরূপ তার বই পড়ার প্রতি চরম আকর্ষণ বোধ করি। ওবায়েদ হক তার লিখাগুলোকে নিজের সন্তান মনে করেন। আর সন্তানের পিতা হিসেবেই তিনি পরিচিত হতে চান।ছোটো একটি বইকে বিস্তৃত না করে কিভাবে কাহিনীগুলোকে একসুতোয় বাঁধা যায় তার প্রমাণ ‘নীল পাহাড়’।

১৯৮৪ সালের ঘটনা।
রাজনৈতিক ক্ষমতাশালী সিনিয়র ডাঃ সোবহান সাহেবের অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় এতিম ডাঃ মানিক মিত্রকে শাস্তিস্বরূপ বান্দরবানের থানচি উপজেলার ইউনিয়ন সাবসেন্টারে পোস্টিং দেয়া হয়। ‘আমরা যেহেতু মগের মুল্লুকে বাস করি তাই ক্ষমতাবানরা তোমার লঘু শাস্তির ব্যবস্থা করেছে’ -ডাঃ বদরুল আলমের এই উক্তিই বলে দেয় শাস্তিটি লঘু ছিল না মোটেই। পাহাড়ের অবস্থা তখন চরম অস্থির। পাহাড়ি বাঙালি বিবাদ, প্রায় প্রতিনিয়ত ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, মাথাচাড়া দিয়ে উঠা বিভিন্ন উগ্র পাহাড়ি সংগঠন যারা বাঙালিদের জন্য বুকে পুষে রেখেছে একবুক ঘৃণা, যাদের কল্যাণে প্রায়ই সাঙ্গু নদীতে ভেসে আসে বাঙালি অফিসারদের মাথাবিহীন লাশ। বাঙালিরাও কম যায় না। সুযোগ বুঝে ঝাপিয়ে পরে নিরীহ জুমচাষীদের উপর।

মানিক এখানে পরিচয় পায় বরকত আলীর মতো জানোয়ারের। তবুও এতো প্রতিকূলতার মাঝেও নিজের কাজ আর পাহাড়ের মায়ায় বলিপাড়ার ছোট্ট কুটিরে নিজেকে আবদ্ধ করে নেয় মানিক। আস্তে আস্তে কুসংস্কারে বিশ্বাসী পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস অর্জনও শুরু করে। হঠাৎ ঢাকা অনাথ আশ্রমের বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক চন্দন বাবুর চিঠি পেয়ে তোলপাড় হয়ে যায় মানিকের ভেতরটা। কি ছিল সেই চিঠিতে? চিঠি পেয়ে ছুটি নিয়ে ঢাকায় ছুটে যেতে গিয়েও যেতে পারেনি সে। তার আগেই অপহরণের শিকার হয়। শুরু হয় নতুন লড়াই। হিংস্রতা তাকে গ্রাস করতে গিয়েও বাঁচিয়ে রাখে পদে পদে। এখানে খুঁজে পায় নতুন জীবন।

পরিচয় পায় ক্রাসিমার মতো পাহাড়ী কন্যার, মংতোর মতো নিষ্ঠাবান বিপ্লবীর, সন্তানহারা পাগল প্রায় উথাই, সন্তানের প্রাণ ভিক্ষাকারী উমে, বিশ্বাসঘাতক আদিবাসী সর্দার থুইনুপ্রু, আরো কিছু চরিত্র মনে দাগ কেটে থাকবে খায়াচিং, আংসাই, কাজাচাই। নিজের জীবন বাজি রেখে উমের সন্তানকে বাঁচানোর যে চেষ্টা মানিকের তা সত্যিই অসাধারণ। মানিকের বুকে ক্রাসিমার জন্য ছিল ভালোবাসার আগ্নেয়গিরি যার উদগীরণ কখনোই হয় না।

পালাতে গিয়ে মানিক মুখোমুখি হয় তার দৃষ্টির ক্যানভাসের সেই নীল পাহাড়ের! সবশেষে মানিক নিজেই নীল পাহাড়ের রহস্য উদঘাটন করে আকস্মিকভাবে যা পাঠকের কল্পনাতীত। এই উপন্যাসে হাজারো ঘটনার মাঝে লেখক মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতার কিছু চিত্রও তুলে এনেছেন ডাঃ মানিক মিত্রের বংশালের বাড়ির প্রাক্তন মালিক ডাঃ সুধীর দত্তের সুখী পরিবারের নিঃশেষ হওয়ার বর্ণনার মাধ্যমে।

লেখক দারুণভাবে অস্থির একটা সময়কে তুলে ধরেছেন তার এই বইটিতে। তাছাড়া কোনো একটা সময় খুব গভীরভাবে খুব কাছ থেকে পাহাড়কে দেখেছি চিনেছি তাই গল্পের মতো করে যেনো কোনো সত্যি ঘটনাই চোখের সামনে ভেসে উঠছিল বার বার। জায়গায় জায়গায় ঘটনার আকস্মিকতায় থম মেরে বসে থাকতে হয়েছে।

কার্তিককে বলা মানিকের সেই কথাটা ‘খাওয়ার সময় আমার ডাল আমি তোকে দিবো, তুই তোর মা আমাকে দিস’- মায়ের আদর ভালোবাসার জন্য ছোটো একটি ছেলের মনের করুণ গভীর আকুতি লেখক কত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এই বাক্যে। আত্নপরিচয় খুঁজতে থাকা একজন এতিম মানুষের গল্পে একই সাথে প্রেম ভালোবাসা মায়া দয়া হিংস্রতা ঘৃণার উপস্থিতি সত্যিই মুগ্ধ করার মতো।

ছোটো একটি বই যে কি পরিমাণ বিষয়বস্তু ধারণ করতে পারে তা এই বইটি না পড়লে সত্যিই বুঝা সম্ভব না। তবে লেখক চাইলে অনায়াসে বইটিকে আরো বিস্তৃত করতে পারতেন। এমন বই আরো অনেক পৃষ্ঠা আশা করাই যায়। ‘নীল পাহাড়’ পড়তে গিয়ে বুঝলাম লেখকের বাক্য গঠনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রসবোধের দিকে প্রবল আকর্ষণ! কিছু সংলাপ কখনোই দুর্বোধ্য নয় কিন্তু গভীরভাবে ভাবনার যোগ্য।


লেখক: আনিকা তাসনিম (সুপ্তি)
লোক প্রশাসন বিভাগ
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ