বুক রিভিউ: শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘পার্থিব’

প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালী সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বৃহৎ প্রেক্ষাপটে তার মনোবৈচিত্র‍্যের স্ফূর্তি ঘটিয়েছেন ‘পার্থিব’ উপন্যাসে। সাহিত্য একাডেমি পুরষ্কার প্রাপ্ত ‘মানবজমিন’ পড়েই তার বইয়ের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি। তারপর পড়েছি ‘দূরবীন’। ‘মানবজমিন’ এর সাথে ‘পার্থিব’ এর ভিত্তিগত মিল থাকলেও এই উপন্যাসে লেখক আরো বৃহৎ পটভূমিতে মানুষের নিজের সাথে নিজের বোঝাপড়ার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন।

শীতলাতলা গ্রামে বিষ্ণুপদ- নয়নতারা সম্পত্তি নিয়ে তাদের দুই ছেলে রামজীবন আর বামাচরণের মারামারি কাটাকাটি গালাগালিতে নাজেহাল। এই সময় তাদের বড় ছেলে কৃষ্ণজীবন পৃথিবী রক্ষার ভাবনার বহিঃপ্রকাশ করছেন ‘ডার্লিং আর্থ’ বই লিখে। ‘পৃথিবী কি দাড়ি কামায় বাবা?’ শিশুপুত্র দোলনের মুখে এই প্রশ্ন শুনে কলকাতার ফ্ল্যাটের ছাদে বসে বিশাল দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে বিশ্ববিখ্যাত এই পরিবেশবিজ্ঞানীর বুক থেকে, পৃথিবীর দাড়ি যে পৃথিবীর মানুষই কামিয়ে ফেলছে! ক্ষতি ডেকে আনছে নিজেদের। মা বাবাকে ছেড়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন অথচ মা- বাবার জন্য এক বুক ভালোবাসা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি তা কে জানতো! তার মন যে মনে আছে সেই অজপাড়া গাঁয়ে! এই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশও তিনি ঘটিয়েছেন। সব ব্যাপারে তার অস্বাভাবিক নির্লিপ্ততাই অধ্যাপিকা স্ত্রী রিয়ার সাথে তার দ্বন্দের কারণ।

ষোড়শী কিশোরী অনুশীলার সাথে তার উদ্ভট অথচ মজার এক সম্পর্কের কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা লেখকও দিতে পারেন নি। কৃষ্ণজীবনের মেয়ে মোহিনীর প্রাইভেট টিউটর ‘চয়ন’ উপন্যাসের সবচেয়ে দুর্বল চরিত্র হয়েও সেই যেনো সবচেয়ে অপরাজেয়! শরীরের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে বাজা ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ নিয়ে ঠাঁয় জীবন বয়ে চলেছে এই মৃগীরোগীর। সবচেয়ে অদ্ভুত চরিত্র চারুশীলা যার অতি আতিথেয়তা আর সরলতায় সবাই হাঁপিয়ে উঠে। ভাইকে সংসারী করতে বিলেত ফেরত তরুণী রশ্নি রায়ের সাথে জুড়ে দিয়ে বিচ্ছিরি এক কাহিনীর অবতারণা করে সে। আর তার কিম্ভুত ভাই ‘হেমাঙ্গ’ যার দ্বিধান্বিত চরিত্রে পাঠকই দিশেহারা হয়ে যায়! কিন্তু তাতে কি, সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাপিয়ে ঝুমকির চোখের ভাষা ঠিকই পড়ে নিয়েছিলো হেমাঙ্গ।

উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে ছিলো বীণাপানি আর নিমাই। বেঁচে থাকার তাড়নায় যে মানুষ কী কী করতে পারে তা বীণাপাণির মাধ্যমে বোঝা যায়। লোভে পাপে তাপে সব হারিয়ে নিঃস্ব বীণাপাণি শেষ পর্যন্ত জায়গা পায় স্বামী নিমাইয়ের কাছেই, যে নিমাই অভাবে স্বভাব ধরে রেখে তার সব পেয়েছিলো। অপর্ণা এক পাক্কা গৃহিণী এবং বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন নারী, স্বামী মনীশের হার্ট এট্যাকের পর থেকেই ভীত সে। মনীশ, অনীশ, অনু আর ঝুমকিকে আগলে রাখতে সে বদ্ধপরিকর কিন্তু কোথায় যেনো তার শান্তির বড় অভাব। অনীশের ক্লাসমেট কালো সাউথ ইন্ডিয়ান বাচ্চা মেয়ে ‘আপা’ এই উপন্যাসের সবচেয়ে বিরল চরিত্র, বন্ধুরা যাকে বঙ্কিমচন্দ্রের দেবী চৌধুরানীর সাথে তুলনা করে।

এই এতো এতো চরিত্রের ছড়াছড়ি আর তাদের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে ভরপুর এ উপন্যাসে খুব উৎসাহী হয়ে উঠার মতো কোনো কাহিনী না থাকলেও সাদামাটা ব্যাপারগুলো হঠাৎ কেমন অসাধারণ হয়ে উঠে তা বুঝেছি। গ্রাম-শহরের মেলবন্ধন, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত অসংখ্য চরিত্র তবে কোনো চরিত্র নিয়ে না ভেবে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই, প্রত্যেকে স্ব স্ব জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি চরিত্রের বিচিত্র রকমের কাহিনীর মারপ্যাঁচে কিছু সময় হাফ ধরে যায়, তবে লেখক আগ্রহ ধরে রেখেছেন তাদের মধ্যে অদ্ভুত সেতুবন্ধনের মাধ্যমে। বিশেষ ভালো লেগেছে নয়নতারা- বিষ্ণুপদের সরল মিষ্টি নির্ভেজাল দাম্পত্য জীবন, মনীশকে নিয়ে অপর্ণার উদ্বেগ।

হেমাঙ্গের মধ্য দিয়ে লেখক যেভাবে এক সাগর দ্বিধাদ্বন্দ্বের পরও নিজের ভালোবাসাকে দিশেহারা হয়ে খুঁজে পাওয়া দেখিয়েছেন তা সত্যিই মজার ছিলো! ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের নিষ্পাপ ভালোবাসা ফুটে উঠেছে বোবা গোপালের প্রতি বড় ভাই পটলের গভীর ভালোবাসার প্রকাশে। বীণাপাণি আর নিমাইয়ের শেষ পরিণতিও মনে তৃপ্তির সঞ্চার করেছে।

তবে উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো কৃষ্ণজীবন, যার সাথে প্রতিটি চরিত্রই জড়িত। উপন্যাস জুড়ে চরিত্রগুলো নিজের সাথেই কথা বলে, নিজের সাথে বোঝাপড়ার এক দৃষ্টান্ত ছিলো এতে। প্রতিটি চরিত্র আর তাদের বিচিত্র রকমের ভাবনার মধ্যে যেনো কিছু জায়গায় নিজেরই প্রতিচ্ছবি পাচ্ছিলাম। উপন্যাসটি মনে অসংখ্য প্রশ্নের উদ্রেক করবে, আবার উপন্যাসের মধ্যেই উত্তর খুঁজে পাবেন। এতো বৃহৎ উপন্যাস নিয়ে কিছু লিখা রীতিমতো ভয়ংকর! কূলকিনারা পাওয়া যায় না, সব চরিত্র নিয়েই লিখার মতো হাজারটা কথা আছে যা লিখে শেষ করার মতো নয়।

শীর্ষেন্দুবাবু আপাদমস্তক মনস্তাত্ত্বিক এই উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে মোটামুটি একটি পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়ে তবেই ইতি ঘটিয়েছেন। আর এ কারণেই হয়তো বইটি শেষ করে মন কিছুটা ভারাক্রান্ত হয়ে থাকলেও অন্যরকম পরিপূর্ণতায় ভরে আছে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর মনোবৈচিত্র‍্য উপলব্ধিকরণে পড়তে হবে বইটি।

উপন্যাসের প্রায় প্রতি পাতায় পাতায় অসংখ্য ভারী ভারী কথার মধ্য থেকে কিছু তুলে এনেছি যা মনকে নাড়া দিতে পারে-

‘মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু হল তার মন। মন ভাল থাকলে দুনিয়াটা ভারী ভালো, আর মন বিগড়োলে পরমান্নও তেতো।’

‘বিদ্যা সকলের থাকে না, কিন্তু বিদ্বানকে খাতির করে না এমন পাষন্ডের সংখ্যা ঈশ্বরের দয়ায় এখনও কম।’

‘খুব সূক্ষ্ম জিনিস বুঝতে গেলে শুধু যুক্তি দিয়ে বোঝা যায় না।’

‘ভালোবাসা এমন একটা জিনিস যা সব জ্ঞানকে গ্রাস করে নিতে পারে।’

‘প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যেই লুকানো অব্যবহৃত কিছু গুণ থেকে যায়। সে হয়তো সারা জীবন নিজের সেই গুণটার কথা জানতেই পারে না। গুণটা থেকেও নষ্ট হয়।’

‘সাফল্য তাকেই বলে যখন মানুষ নিজের সঙ্গে এই গোটা বিশ্বজগতের প্রকৃত সম্পর্কটা আবিষ্কার করতে পারে।’

‘মানুষের কোনো গন্তব্য নেই, শুধু গতি আছে।’

‘দুনিয়ায় যত সাধুবাদ আছে তার মধ্যে একটু করে মিথ্যে ঢুকে থাকেই। যত প্রশংসাবাক্য আছে তার অধিকাংশ ই একটু বাড়তি কথা।’

‘যা কিছু দেখবে, যাকে দেখবে, তাকেই ভালোবাসার চেষ্টা কোরো৷ ভালোবাসা মানেই কিন্তু ভালো করা। তার ভালোর জন্য কিছু যদি না-ই করলে, তাহলে ভালোবাসা বন্ধ্যা হয়ে গেল, মিথ্যে হয়ে গেল।’

‘মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করলে দাঁড়ানোর জমি পাবে না। বাঙালিরা বড্ড তাড়াতাড়ি আন্তর্জাতিক হয়ে যায় তাই তাদের শক্তি কম।’

‘দুনিয়াতে পালিয়ে যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। মানুষের পালানোর সবচেয়ে ভালো জায়গা হলো তার মন। যদি সেখানে ঢুকে কপাট বন্ধ করে দিতে পারি তবে কেউ আর নাগাল পাবে না।’

‘পুরুষ মানুষের মধ্যে যা আছে, মেয়ে মানুষের মধ্যে তা নেই। আবার মেয়ে মানুষের মধ্যেও এমন কিছু আছে যা পুরুষের নেই। হরেদরে দু’পক্ষই সমান। যিনি মানুষ তৈরি করেছেন তিনি তো আর আহাম্মক নন, একচোখাও নন। সমান সমানই দিয়েছেন দুজনকে, তবে রকমটা আলাদা।’

‘যে কখনো কাউকে শাসন করতে পারে না, তর্ক বা ঝগড়া কখনো করেই না তার কি রাগ হয় না! হয়৷ কিন্তু সেই রাগ যেনো এক অন্ধ হাতির মতো দাপাদাপি করে তারই ভিতরে। তার হৃদযন্ত্রে, পাকস্থলীতে, ফুসফুসে, মস্তিষ্কে সর্বত্র সেই অন্ধ রাগের ধাক্কা গিয়ে লাগে। তাকে ক্লান্ত করে দেয়, বিধ্বস্ত করে ফেলে, নিঃঝুম করে দেয়।’


সর্বশেষ সংবাদ