বুক রিভিউ

যুদ্ধ-হত্যা-সাম্রাজ্যবাদ যেভাবে জায়েজ করে পশ্চিমা গণমাধ্যম

  © টিডিসি ফটো

পশ্চিমা গণমাধ্যম সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠায় যেভাবে ভূমিকা রাখছে তার বিষয়বস্তু নিয়ে নোয়াম চমস্কি ও আন্দ্রে ভিচেক’র বই On Western Terrorism: From Hiroshima to Drone Warfare (হিরোশিমা থেকে ড্রোনযুদ্ধ)। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের পাঠকরদের জন্য রিভিউ লিখেছেন- সোহেল রানা

পশ্চিমা গণমাধ্যম কীভাবে সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখছে এই বইয়ের বিষয়বস্তু সেটাই। নোয়াম চমস্কি ও আন্দ্রে ভিচেকের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে তারই স্কেচ আঁকা হয়েছে। দুজনই পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। প্রথমজন এমআইটির অধ্যাপক ও বিশ্বের অন্যতম সেরা বুদ্ধিজীবী আর দ্বিতীয়জনের বড় পরিচয় তিনি একজন সাংবাদিক। কাশ্মীর, বসনিয়া, রুয়ান্ডা,উগান্ডা, ইসরায়েল, প্যালেস্টাইন, তুরস্ক, পূর্ব তিমুর, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা ও মেক্সিকো সহ বিভিন্ন দেশ ও জায়গা সরেজমিন ঘুরে রিপোর্টিং এর অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। আন্দ্রে ভিচেক তাঁর ভূমিকায় লিখেছেন-

“প্রায় সবকটি মহাদেশে যে ভয়াবহ যুদ্ধ, আগ্রাসন ও সংঘর্ষ চলছে তা সশরীরে দেখে, ভেতরের খবরাখবর নিয়ে আমি মোটামুটিভাবে নিশ্চিত যে, এই সবকটি যুদ্ধ, আগ্রাসন, দেশ দখলের পরিকল্পনা হয়েছে পশ্চিমাদের ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষার জন্য। ধর্মীয় মৌলবাদী ও নিবর্তনমূলক রাষ্ট্রগুলোকে প্রায়শই বলা হচ্ছে শান্তিপ্রিয় ও মডারেট হিসেবে আর জাতীয়তাবাদী ও সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ দেশগুলোকে উপস্থাপন করা হচ্ছে দানব হিসেবে।”

বইটির শুরুতেই একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী ষাটবছরে সারা দুনিয়াতে প্রায় পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ মারা গেছে পশ্চিমা উপনিবেশবাদ আর নয়া উপনিবেশবাদী তৎপরতায়। কিন্তু কীভাবে? এর উত্তর আছে চমস্কি আর ভিচেকের আলোচনায়। বইটিতে জাতীয়তাবাদী আর সমাজতান্ত্রিক শাসকদের উপস্থাপন করা হয়েছে অনেকটা ফেরেশতার মত করে, আর পশ্চিমের গণতন্ত্র আর পুঁজিবাদীদের দেখানো হয়েছে দানব হিসেবে। বাইরের বিশ্বে গণতন্ত্র আর শান্তি বিলানোর যে পশ্চিমা আয়োজন লেখকদ্বয় এই চেষ্টাকে বলতে চেয়েছেন সাম্রাজ্যবাদ স্থাপনের অপচেষ্টা হিসেবে। আর এই সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে পশ্চিমারা ভিয়েতনাম, ইরাক, ইন্দোনেশিয়া, কঙ্গো, রুয়ান্ডার মতো দেশগুলোতে কী নির্মমতার চিহ্ন রেখে গেছে সেসবের তথ্য উঠে এসেছে এখানে।

রিপাবলিক কঙ্গোতে সবশেষ গৃহযুদ্ধে মারা গেছে কমপক্ষে ষাট লাখের মত মানুষ, বেলজিয়ামের রাজা লিওপোল্ডের হাতে খুন হয়েছিল কঙ্গোর কোটি মানুষ। দুটি ঘটনার পেছনেই আছে সাম্রাজ্যবাদ, কিন্তু এর দায় পশ্চিমারা নেয়নি। নেপথ্যে পশ্চিমের ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ থাকলেও তার দায় স্থানীয় শাসকদের কাঁধেই চাপানো হয়েছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় নাপাম বোমা মারা হয়েছিল সেখানকার শস্য ও ফসল নষ্ট করতে। এই নির্দেশ দিয়েছিলেন জন এফ কেনেডি। ১৯৭০ এর দশকে কম্বোডিয়াতে ব্যাপক বোমা বর্ষণের নির্দেশ দিয়েছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। লাওসের গ্রামগুলোতে বোমাবর্ষণ করেছে মার্কিনিরা। পশ্চিমা গণমাধ্যম এসব হামলাকে ‘জায়েজ’ হিসেবে দেখিয়েছে। বইটিতে বলা হয়েছে, পশ্চিমা শক্তি দুনিয়ার বিভিন্ন স্থানে যে ভয়াবহ আক্রমণ-নিপীড়ন চালিয়েছে, বিভিন্ন সময় সমাজ ও রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করেছে, ধ্বংস করেছে; পরবর্তীতে সে সকল স্থানে ব্যাপক প্রোপাগান্ডা চালিয়ে সেসকল জনপদের মানুষকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে পশ্চিমাদের এই সব ভয়াবহ নিপীড়নের কথা। কিন্তু এসব প্রোপাগান্ডা কারা চালিয়েছিল? অথবা কাদেরকে ব্যবহার করা হয়েছিল? বইটিতে পশ্চিমা প্রোপাগান্ডা (গণমাধ্যম) সম্পর্কে বলা হয়েছে-

“পশ্চিমা প্রোপাগান্ডা চাইলে দুনিয়ার যেকোন প্রান্ত থেকে মানুষকে এক করে ফেলতে পারে, জড়ো করতে পারে যেকোন উদ্দেশ্যে, যে কোন লক্ষ্যে। যেকোন কারনেই হোক এরা দেশে দেশে সামরিক সংঘাত, ভয়াবহ সংঘর্ষ এবং কথিত পরিবর্তনের সংগ্রাম তৈরি করতে পারে। এটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শান্তিপ্রিয় দেশকে বলতে পারে সবচেয়ে ভয়াবহ দেশ এবং তাকে বলতে পারে বিশ্বশান্তির জন্য এক ভয়াবহ হুমকি। এবং এরা পশ্চিমের একগাদা দেশ যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী সারা দুনিয়াকে আতঙ্কের সভ্যতা বানিয়ে রেখেছে তাদেরকেই তুলে ধরতে পারে দুনিয়ার শান্তি ও গণতন্ত্রের প্রধান রক্ষক হিসেবে।”

নোয়াম চমস্কি বলেন, ১৯৫৩ সালে ইরানের মোসাদ্দেক সরকার উৎখাতের ঘটনাকে নিউ ইয়র্ক টাইমস উল্লেখ করেছিল মহান ঘটনা হিসেবে। তিনি সমালোচনা করেছেন বিবিসি ও এবিসির। চমস্কির বক্তব্য- “আমার ধারণা ইতিহাসে একজন ব্যক্তি এই বিষয়ে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মত ছিলেন, তিনি হলেন গোয়েবলস। তিনি লিখেছিলেন যে, তিনি নাৎসি প্রচারণা বা প্রোপাগান্ডাগুলোকে তৈরি করতেন আমেরিকান বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনগুলো থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে।”

বইয়ের আলোচনায় এসেছে কাশ্মীর ও পাক-ভারত বিভাজনের মত বিষয়গুলোও। আন্দ্রে ভিচেকের মতে, ভারত পৃথিবীর অন্যতম নিপীড়নমূলক দেশ আর সেই তুলনায় চীন অনেক সোজা সাপ্টা দেশ। ভারত-পাকিস্তানের মিডিয়ার সমালোচনা করা হলেও চীন, ইরানের মত দেশগুলোর গণমাধ্যমকে অধিক উদার বলে দাবি করা হয়েছে। যদিও এই জায়গায় এসে বইয়ের বক্তব্যের সাথে আমি একমত হতে পারিনি। পুরো বই পড়ে আমার মনে হয়েছে চীন, ভেনেজুয়েলার মতো দেশগুলোকে মহান করে দেখানোর একটা প্রচেষ্টা ছিল বইটিতে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের নেংটা করে দিতে গিয়ে কমিউনিজমকে এতো মহান করে দেখানোর প্রয়োজন ছিলনা। তবে নোয়াম চমস্কির একটা বক্তব্য এখানে গুরুত্বপূর্ণ-

“মিশর ও তিউনিসিয়াতে আমেরিকা ও তার মিত্ররা একই গেইম প্ল্যান বা পরিকল্পনা ব্যবহার করে যা তারা বহুবার পৃথিবীর নানান দেশে ব্যবহার করেছে। পরিকল্পনাটা হচ্ছে, প্রথমে স্থানীয় স্বৈরশাসককে সমর্থন করা, পরে যদি কোন কারনে সেই স্বৈরশাসক আর দাঁড়াতে না পারে তাহলে এই সকল স্বৈরশাসকদের অন্য কোন দেশে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া এবং আবার পুরনো শাসকদের সাথে এসে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করা এবং অবশ্যই এসবের ফাঁকে ফাঁকে বারবার জানান দেওয়া যে, এসবই করা হচ্ছে গণতন্ত্রের স্বার্থে। এবং জানান দেওয়া যে, আমেরিকা ও তার মিত্ররা আসলেই গণতন্ত্রের এক বিরাট প্রেমিক।”

লেখাটা শেষ করতে চাই আন্দ্রে ভিচেকের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে- “ইস্তাম্বুলের কোন আড্ডায় যদি আপনি বলেন টুইন টাওয়ার আমেরিকান সরকার উড়িয়ে দেয়নি, তাহলে অনেকেই আপনার দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকাবে। আপনার এই ধরনের বক্তব্য অনেকটা মূলধারার প্রথাগত পত্রিকাগুলোর মতই শোনাবে সেখানে।”

মূল বইটি পড়ার সুযোগ আমার হয়নি। মুহাম্মদ গোলাম সারওয়ার এর অনুবাদ যথেষ্ঠ গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। তাঁর অনুবাদ প্রকাশ করেছে চৈতন্য প্রকাশনী, মূল্য সাড়ে তিনশো টাকা।


সর্বশেষ সংবাদ