বুক রিভিউ

যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদ কায়েমের করুণ কাহিনী

যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে সাম্রাজ্যবাদ কায়েম করেছে সেই করুণ কাহিনী নিয়ে জন পার্কিন্সের বই Confessions of an Economic Hit Man (এক অর্থনৈতিক ঘাতকের স্বীকারোক্তি)। রিভিউ লিখেছেন- সোহেল রানা

বইটির বিষয়বস্তু ‘কর্পোরেটোক্রেসি’। লেখক বলতে চেয়েছেন, বর্তমান বিশ্ব সাম্রাজ্যের ভিত্তিই হচ্ছে এই ‘কর্পোরেটোক্রেসি’। কেবল লেখক বলতে চেয়েছেন এই কারনে নয়, এটি এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। কীভাবে? পরাশক্তিগুলো বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুর্বল অথচ খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ ও ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রে তার সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ কায়েম করতে ধারাবাহিক কিছু কর্মপ্রক্রিয়া নিয়ে এগোয়। প্রথমত নির্ভর করা হয় অর্থনৈতিক ঘাতকের উপর। এতে ব্যর্থ হলে প্ল্যান-বি। লেখক এই দ্বিতীয় ধাপে শৃগালের (সিআইএ) উপর ভরসা করাকে বুঝিয়েছেন। ১৯৫৩ সালে ইরানের মোসাদ্দেক সরকারকে উৎখাত ও আশির দশকে পানামার ওমর তোরিজের মৃত্যুর পেছনে আছে শৃগাল। প্লান-বি ব্যর্থ হলে প্লান-সি বা চূড়ান্ত পদক্ষেপ। সরাসরি সামরিক আক্রমণ। আমরা প্ল্যান-সি কার্যকর হতে দেখেছি ইরাকের সাদ্দামকে উৎখাত আর পানামার লৌহমানব ম্যানুয়েল নরিয়েগাকে তুলে নিয়ে এসে ৪০ বছরের কারাদন্ড দেওয়ার ঘটনায়।

কর্পোরেটোক্রেসির মত জঘন্যতম পথ কেবল যে যুক্তরাষ্ট্রই অনুসরণ করছে ব্যাপারটা সেরকম নয়। চীন, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জাপান আর রাশিয়াও একইপথে হাঁটছে। এই সময়ে এসে আফ্রো-এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকায় চীন যে ধরনের কর্পোরেটোক্রেসি প্র্যাকটিস করছে, তা অন্য যেকোন রাষ্ট্রের তুলনায় ভয়ংকরতম। লেখক জন পার্কিন্স একজন অর্থনীতিবিদ যিনি কাজ করেছেন মেইন নামের একটি কনসালটিং ফার্মে। তার কাজ ছিল অর্থনৈতিক প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করা। এই ধরনের কোম্পানিগুলো কাজ করে থাকে মূলত সেই সব দেশে যেখানে রয়েছে বিপুল খনিজ সম্পদ কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কোন স্থাপনা। তেল সমৃদ্ধ দেশগুলোই তাদের মূল টার্গেট। জন পার্কিন্স টার্গেট দেশগুলোর নেতাদের কাছে বড় বড় প্রজেক্ট নেওয়ার গুরুত্ব তুলে ধরতেন। বোঝাতে চাইতেন অমুক প্রকল্প হাতে নেওয়া হলে জিডিপি হবে ১৭/১৮%। পার্কিংন্সের এই মূল্যায়ণ ছিল অতিরিক্ত। বাস্তবে যা ৫,৬, বা ৭ র্পাসেন্ট। এ কারনে গোপনে তাদের বলা হতো অর্থনৈতিক ঘাতক যাদের কাজই ছিল উন্নয়নের মূলা দেখিয়ে ভিনদেশের অর্থ কৌশলে হাতিয়ে নেওয়া। কোম্পানি থেকে নির্দেশনা ছিল প্রকল্পের সম্ভাব্য ফলাফল বাড়িয়ে দেখাতে হবে যাতে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র বিপুল ঋণ গ্রহণে উদ্ধুদ্ধ হয়। তারপর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব পেতো মেইনের মত মার্কিন বহুজাতিক বাণিজ্য সংস্থাগুলো। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ করা অর্থ ফিরে যেতো যুক্তরাষ্ট্রেই, অন্যদিকে ঋণগ্রহণকারী দেশগুলো ঋণের ভারে জর্জরিত হতো বা হচ্ছে। এর বাইরেও টার্গেট রাষ্ট্র থেকে বিপুল অর্থ পাচার হতো যুক্তরাষ্ট্রে যেমনটা এখন সৌদি আরব থেকে হচ্ছে। কিন্তু ঋণ যারা পরিশোধ করতে পারতনা বা পারছেনা তাদের পরিণতি কী? লেখক বলছেন-

      “ঋণের অর্থ হাতে না পেলেও ঋণগ্রহীতা দেশকে সুদে-আসলে পরিশোধ করতে হয়। যখন একজন অর্থনৈতিক ঘাতক পুরোপুরিভাবে সফল হন তখন ঋণের অংক বিশাল আকার ধারণ করে। তখন কয়েক বছরের মধ্যেই ঋণগ্রহীতা দেশটি ঋণখেলাপীতে পরিণত হতে বাধ্য হয়। যখনই এই ঘটনা ঘটে তখনই আমরা মাফিয়ার মত ঋণখেলাপী দেশটির টুঁটি চেপে ধরে আমাদের স্বার্থ হাসিল করি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে জাতিসংঘে আমাদের প্রস্তাবের পক্ষে ভোট প্রদান, ঋণখেলাপী দেশে আমাদের সামরিক ঘাঁটি স্থাপন, আমাদের বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোর হাতে ঋণখেলাপী দেশের প্রাকৃতিক সম্পদকে তুলে দেওয়া অথবা ঋণখেলাপী দেশের উপর দিয়ে অবাধে আমাদের যাতায়াতের অধিকার অর্জন করা। তারপরেও ঋণখেলাপী দেশটি আমাদের কাছে ঋণীই থাকে। সেই সাথে আমাদের বিশ্ব সাম্রাজ্যে আরেকটি দেশ সংযুক্ত হয়। ”

যুক্তরাষ্ট্র কর্পোরেটোক্রেসিতে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি সফলতা দেখিয়েছে সৌদি আরবে। এর শুরু ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর। সে সময় ইসরায়েলকে সহায়তার দায়ে পশ্চিমের বিরুদ্ধে তেল অবরোধ দিয়েছিল সৌদি নেতৃত্বাধীন সাতটি আরব-অনারব দেশ। এই অবরোধ যুক্তরাষ্ট্রকে বাধ্য করেছিল শাটল কূটনীতির মাধ্যমে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সমাপ্তি টানতে। তখন থেকেই তেলসমৃদ্ধ সৌদি আরবের প্রতি দুর্বলতা বাড়ে যুক্তরাষ্ট্রের। কারন তেল অবরোধে ব্যারেল প্রতি কয়েকগুণ দাম বাড়ায় প্রচুর পেট্রোডলার জমেছিল সৌদি কোষাগারে। কর্পোরেটোক্রেসির নেতাগণ কীভাবে সেই অর্থ আমেরিকায় নিয়ে আসা যায় তাঁর পরিকল্পনা করতে থাকে। সৌদি ভবিষ্যতে তেল অবরোধ দেবেনা-এমন নিশ্চয়তা চাইল যুক্তরাষ্ট্র, বিনিময়ে রাজনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতার প্রস্তাব দেওয়া হলো বাদশাহ ফয়সালকে। এই সহযোগিতা সউদ পরিবারের শাসন দীর্ঘায়িত করবে- এই ভেবে মেনে নেওয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব। এরপর যা হলো- সৌদিতে মার্কিন কোম্পানিগুলো এলো,বিশাল বিশাল উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হলো। সৌদি অবকাঠামো উন্নত হলো, সেই সাথে পেট্রোডলার পাচার হতে থাকলো আমেরিকায়! কিন্তু সৌদি মডেল কাজ করেনি ইরাকে। সাদ্দাম রাজি হননি। এর প্রতিশোধ প্রথম দফায় ১৯৯১ সালে এবং সবশেষ ২০০৩ সালে সাদ্দামকে উৎখাত করে নেওয়া হয়। লেখক বইটিতে উল্লেখ করেছেন-

      “যদি সাদ্দাম হোসেন সউদ পরিবারের মত একই ভূমিকা পালন করতে রাজি হতেন তাহলে ইরাকে তার শাসন দীর্ঘায়িত হতো। তখন তিনি তার পছন্দসই মিসাইল ও গণবিধ্বংসী অস্ত্রগুলোকে নির্মাণ করতে পারতেন। তার বিশ্বস্ত আনুগত্যের পুরস্কার স্বরূপ যুক্তরাষ্ট্র তাকে এসব মারণাস্ত্র তৈরির কারখানা উপহার দিতো। এমন কি মার্কিন বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা এসব কারখানাকে উন্নয়ন করার ও সচল করে রাখার দায়িত্ব পেতো। সেই সাথে ইরাককে একটি আধুনিক দেশরূপে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হতো। অবশ্য সবই হতো ইরাকের পেট্রো ডলারের বিনিময়ে। এক কথায় সৌদি আরবের মতো ইরাকও হতো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁস। "

মেইনে কাজ করার সুবাদে লেখককে পানামা, ইকুয়েডরসহ বিভিন্ন দেশ সফর করতে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অবাধ্য হওয়া বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানদের পরিণতি ফুটে এসেছে তার বর্ণনায়। ইন্দোনেশিয়া, ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর, পেরু, চিলি, আফগানিস্তান, ইরাক, ইরানসহ বিভিন্ন দেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার নানা চেষ্টার তথ্য আছে বইটিতে। জানা যাবে খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ না হয়েও পানামা কেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষোভের আগুনে পুড়েছিল? মূল বইটি পড়ার সুযোগ হয়নি। অনুবাদ পড়েছি দেবাশিস চক্রবর্তীর। অনুবাদ তুলনামূলক ভালই হয়েছে।

অন্যের অর্থনীতি ধ্বংস করে নিজেদের অর্থনীতি শক্তিশালী করার এই ঘৃণ্য আয়োজনে যুক্ত থাকায় লেখক একটা সময় পর অনুতপ্ত হয়েছিলেন। সেই অনুতাপ থেকেই তার মেয়ের পরামর্শে বইটি লেখা।

শেষ করবো এক সন্ধ্যায় ওয়াল স্ট্রীটে এক আফগান ভিখারীর সাথে লেখকের কথোপকথন দিয়ে---
সে(আফগান) প্রশ্ন করলো, ‘আপনি কি সৈনিক ছিলেন?’

আমি হাসলাম। ‘না, আমি একজন অর্থনৈতিক পরামর্শদাতা।’ তাকে পরিসংখ্যান বোঝাই কাগজটি দেখিয়ে বললাম, ‘এগুলো আমার অস্ত্র’।

সে কাগজটিতে চোখ বুলিয়ে হেসে ফেলল, ‘আমি পড়তে পারিনা’।

আমি বললাম, “প্রতিদিন ক্ষুধার কারণে ২৪ হাজার লোক মৃত্যুবরণ করে- এই কথাটিই এই কাগজে লেখা রয়েছে। ”

সে হাল্কা সুরে শীষ দিলো। এরপর কতক্ষণ চিন্তা করে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, “আমার পরিণতিও হয়তোবা তাই হতো। কান্দাহারের কাছের একটি গ্রামে আমার একটি ডালিমের খামার ছিল। রাশিয়ানরা এলো। মুজাহেদিনরা গাছের আড়ালে ও পানির নালায় লুকালো। তুমুল গেরিলা যুদ্ধ ঘটল। আমার খামার একেবারে ধ্বংস হয়ে গেলো।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এরপর আপনি কাজ কী করতেন?’ সে আমার হাতের কাগজটির দিকে তাকিয়ে পাল্ট প্রশ্ন করলো, “ওটাতে কি ভিক্ষুকদের কথা লেখা রয়েছে? আমি ওদের একজন ছিলাম। ”এরপর সে কতক্ষণ চিন্তায় ডুবে রইল। তারপর বলল, “আমার সন্তান দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলো। আমি পপির চাষ শুরু করলাম।”

আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘আফিম’?

সে কাঁধ ঝাঁকালো- “কোন গাছ নেই। পানি নেই এক ফোঁটা। তাই পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখতে একমাত্র উপায় এটা।"


সর্বশেষ সংবাদ