বুক রিভিউ: সময়ের ফুলে বিষপিঁপড়া

‘সময়ের ফুলে বিষপিঁপড়া’ বই এবং বুসরাত জাহান
‘সময়ের ফুলে বিষপিঁপড়া’ বই এবং বুসরাত জাহান

বাংলাদেশের প্রখ্যাত নারী ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেন রচিত ‘সময়ের ফুলে বিষপিঁপড়া’ বইটির রিভিউ লিখেছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি অর্থনীতি বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী— বুসরাত জাহান

সেলিনা হোসেনের বই পড়ব পড়ব করে এতোদিন পড়া হয়ে উঠেনি। ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ চলচ্চিত্রটি খুব পছন্দের। এত সুন্দর উপন্যাস যার লেখা তার বই আশ্বস্ত হয়ে কিনে পড়া যায়। এই বই কিনতে গেয়ে আমি এলোপাথাড়ি একটা পৃষ্ঠা খুলেছি আর শেষের পাতার শেষ লাইনটা পড়েছি। আমি ঠিক করেছি বইটি আমি কিনবই।

বইটি প্রেমের উপন্যাস বলা চলে। মাঝে মাঝে ‘সুবোধ’ও উকি দিয়ে গেছে অনেকবার। নায়কের নাম মাহবুব যাকে তার প্রেমিকা নাম দিয়েছিল ভালবেসে অমিত। নায়িকার নাম কিন্নরী। যাকে মাহবুব নাম দিয়েছিল শেষে দিকে ‘বিষপিঁপড়া’। মাহবুব থাকে হরিণঘাটা। কিন্নরীকুহু থাকে ঢাকায়। প্রেমের পর কিন্নরী জানতে পারে মাহবুব ‘মাইল্ড অটিজমে’ আক্রান্ত। মাহবুব একটু অন্যরকম সে এটা বুঝত।কিন্তু রোগটার কথা সে জেনেছে মাহবুবের মায়ের কাছ থেকে।

মাইল্ড অটিজম হলো তারা নিজেদের চিন্তার জগতে আশেপাশের মানুষকে ছাড়া অনেক্ষণ সময় কাটিয়ে দিতে পারে। ছোট্ট ছোট্ট বিষয় নিয়ে তারা একা একা বসে ঘন্টার পর ঘন্টা ভাবতে পারে। একটা সময় কিন্নরী আর মাহবুবের সম্পর্কটা শেষ হয়ে যায়। দুজন দুজায়গায় চাকরি করা শুরু করে।

কিন্নরী পালক মেয়ে থাকে। মূলত কিন্নরীর অংশটুকুই বেশি অসাধারণ লেগেছে। খুব সাধারণ একটা গল্প কখন যেন মুগ্ধতায় ছেয়ে গেছে। কিন্নরীকে সারাদিন মাহবুবের কথা ভাবায়। মাহবুব প্রেম বুঝে না। কিন্তু কিন্নরীর জগতে মাহবুব ছেয়ে আছে অসীম ভালবাসা নিয়ে। এভাবেই গল্প চলতে থাকে।কিন্নরীর একসময় মনে হয় মাহবুবের সাথেই কি বাকি জীবনটা কাটানো যায় না। এলোমেলো ভাবনার মাহবুব, হরিণঘাটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সেখানের সুখ দুঃখ, সহজ-সরল মানুষ আর অপর প্রান্তে মাহবুবের জন্যে জমে থাকা ভালবাসা আর মমতার কিন্নরীকে নিয়ে ‘সময়ের ফুলে বিষপিঁপড়া’।

বইয়ের কয়েকটা জায়গার অসাধারণ কথাগুলো না বললেই হয় না—
‘মাহবুব আমার প্রেম বোঝে না, এমন কষ্ট নিয়ে দিন কাটানো, ঘুম নষ্ট হওয়া, এসব তো একরকম বেঁচে থাকা। ভালো কি মন্দ সে-ই বুঝে, যে দিনটি যাপন করবে’, ‘চোখের পানিতে বালিশে একটা নদী তৈরি হয়ে যাক’,‘প্রেমে পড়ার পরে প্রেমের স্মৃতি খুব স্বস্তির নয়’,‘নিজেকে বলে কিন্নরী, তুমি আমাকে ভালবাসো অমিত। এভাবে বলা তোমার প্রকাশ।এখন থেকে আমি তোমার ভালবাসার স্বরূপ বুঝব এভাবে।আমি তোমাকে ভালোবাসা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখব,নিজের বেঁচে থাকাও সুন্দর করব।’

আজিজ লোকটি কিন্নরীকে বলে, ‘প্রেমিক? কখনো তো বলেননি। আমরা তো জানি আপনার সম্পর্কই গড়ে ওঠেনি।’ জানবেন কি করে? আমি তো ঢোল বাজিয়ে বিষয়টি প্রচার করিনি।প্রেম আমার একান্তই ব্যক্তিগত অনুভব’,‘ব্যক্তির কাছে ভালবাসার অনেক দাবি আছে।সেই দাবি পূরণ করলে ভালোবাসা সোনার হরিণ হয়ে যায় না।সেটা সচল হরিণ হয়ে বিচিত্র সৌরভ নিয়ে দৌড়ায়’।

মাহবুব কিন্নরীকে বলে, ‘যেদিন ভোরবেলা সূর্য ওঠার আগে তোমার দরজায় শব্দ হবে সেদিন বুঝবে আজই বিয়ে’,‘নিজেকেই মৃদুস্বরে বলে কিন্নরী, তুমি মাহবুবের কাছে হেরে গেছ।ভালবাসার দৌড়ে ও এগিয়ে আছে। প্রশ্নের উত্তরে বলে, এতে আমি খুশি। অমিতের বিজয়ে ওকে আমি অভিনন্দন জানাই’। মাহবুব কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘এখন থেকে শরীর একটা। দুয়ে মিলে এক।’
১৫৯ পৃষ্ঠার এই বইটা আমি বড়োজোর ৪-৫ ঘন্টা নিয়েছি শেষ করতে। এতই ভালো লেগেছে কেন কে জানে।